বাড়ছে বরাত, পুরোদস্তুর প্রতিমা শিল্পী হয়ে উঠেছেন গৃহবধূ যমুনা
top of page

বাড়ছে বরাত, পুরোদস্তুর প্রতিমা শিল্পী হয়ে উঠেছেন গৃহবধূ যমুনা

ভাঙা জানালা দিয়ে চাঁদের আলোটা এসে পড়ত বিছানায়৷ নরম আলোয় ঘুমন্ত স্বামীর মুখটা দেখেই যেতেন নববধূ৷ এভাবে মুখ দেখে গড়িয়েছে দিন৷ ততদিনে বধূ বুঝেছেন, জোছনা তাঁকে আড়ি করে গলি দিয়ে চলে গিয়েছে৷ বিয়ের আগে তিল তিল করে সাজানো স্বপ্নটা মিলিয়ে গিয়েছে আঁধারে৷ তাই তিনিই জোছনাকে আড়ি করে, কোমরে শাড়ি পেঁচিয়ে স্বামীর হাত ধরে নেমে পড়েছিলেন৷ নববধূ তখন পাকা গৃহিনী৷ বয়সে নয়, মনে৷ বুঝে ফেলেছিলেন, ‘সংসার’ শব্দের পরতে পরতে জড়িয়ে লড়াই৷ ঘাম-রক্তের সেই লড়াই জন্ম দিয়েছে মৃৎশিল্পী যমুনা সরকারের৷

পেরিয়ে গিয়েছে পাক্কা বাইশটা বছর৷ ঘরের ভাঙা জানালায় এখন কাচের শার্সি৷ ফের ঘরে ঢোকে জোছনা৷ কিন্তু দূরের ঝলসানো চাঁদের নরম আলোয় ঘুমন্ত স্বামীর মুখ দেখার অবকাশ নেই যমুনাদেবীর৷ রাতের কাজ সেরে বিছানায় যাওয়ার সময় পরদিনের চিন্তা মাথায় ঘোরে তাঁর৷ তখন আর নববধূ নন তিনি৷ তিন তিনটি ছেলেমেয়ের মা৷ সবার বিয়ে দিয়ে নিজের সাংসারিক দায়িত্ব শেষ করার দৌড়ে শামিল৷ দীর্ঘদিন আগে সংসারের চাকা ঘোরানোর দায়িত্ব, এখন নেশায় পরিণত৷ তাছাড়া এই বাইশটা বছর ধরে গরিবির স্রোতে সাঁতার কাটতে কাটতে শরীরটা প্রায় ভেঙে গিয়েছে স্বামীরও৷ এই সময় তাঁর শরীর আর মনটাকে আগলে রাখার দায়িত্বটাও যে যমুনাদেবীর কাঁধে৷


এখনও এই মহিলা মৃৎশিল্পীর মাথায় ঘোরে পুরোনো দিনের কত ছায়াআলো! জ্বলজ্বলে স্মৃতিতে আলোর থেকে অন্ধকারটাই অনেক বেশি৷ বাবার বাড়ি পুরাতন মালদার মুচিয়া গ্রামে৷ বাবা সামান্য কৃষক৷ দেখাশোনা করেই বিয়ে হয়েছিল পুরাতন মালদা পুরসভার পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের কদমতলার যুবক অনিল সরকারের সঙ্গে৷ অনিল মৃৎশিল্পী৷ শুনেছিলেন, তাঁর কাজকর্ম বেশ ভালোই চলে৷ অভাবের সংসারে মানুষ হলেও বিয়ের আগে সব মেয়েই স্বামীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে৷ যমুনাদেবীও তার বাইরে নন৷ তিনিও রাতের পর রাত জেগে হবু স্বামীকে নিয়ে স্বপ্নের মালা গেঁথেছিলেন৷ সেই স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে মুচিয়া থেকে তাঁর হাত ধরে নিজের ঘরে নিয়ে যান অনিলবাবু৷ প্রথম ক’দিন লোকজনের ভিড়ে কিছু বুঝতে পারেননি৷ যখন বুঝলেন, এক লহমায় স্বপ্ন ভেঙে খানখান৷ স্বামীর আয় তেমন কিছুই নয়৷ দু’বেলা ভালোমন্দ খাবারটাও জোটে না৷ তাই স্বপ্নকে হাঁফড় চাপা দিয়ে স্বামীর হাত ধরেই মাটির প্রতিমা গড়ার কাজ শিখতে শুরু করলেন৷ ঝক্কির কাজ৷ শিখতেই সময় লেগে যায় পাঁচটা বছর৷ ধীরে ধীরে এলাকায় মৃৎশিল্পী হিসাবে নাম ছড়াতে শুরু করে যমুনাদেবীর৷ প্রথমদিকের ছোটো ঠাকুরের জায়গা করে নেয় দুর্গাপ্রতিমা৷




পুরাতন মালদার রসোপুল এলাকায় ছোট্ট কারখানা যমুনাদেবীর৷ করোনা আবহেও এবার চারটি মাতৃমূর্তির বরাত পেয়েছেন৷ কাজে হাতও দিয়েছেন৷ কিন্তু বাঁধ সেধেছে আশ্বিনের বৃষ্টি৷ তারই মধ্যে সময় সুযোগ পেলে খড়ের কাঠামোর উপর দিচ্ছেন মাটির প্রলেপ৷ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন অনিলবাবুও৷ এখন তিনিই যেন তাঁর দুগ্গার সহকারী৷ যমুনাদেবী জানান, বিয়ের পর স্বামীর আর্থিক পরিস্থিতি ভালো ছিল না৷ সে ছোটো থেকে মূর্তি গড়ার কাজটাই শিখেছিল৷ অন্য কোনও কাজ জানে না৷ এরই মধ্যে আমাদের তিনটি ছেলেমেয়ে হয়ে যায়৷ কীভাবে সংসার চলবে, ভেবেই আকুল দু’জন৷ তখনই ঠিক করি, আমিও প্রতিমা গড়ার কাজ শিখব৷ স্বামীর হাত ধরে শুরু করি মূর্তি গড়া৷ কাজ শিখতে লেগে যায় পাঁচটি বছর৷ এখন আমি নিজেই প্রতিমার কাঠামো তৈরি করি, মাটি লাগাই, এমনকি চোখও আঁকি৷ এভাবেই ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়েছি৷ চাইছি, এই কাজটা কিছু গরিব মেয়েকে শেখাই৷ যাতে বিয়ের পর তাদের কেউ আমার মতো হঠাৎ দুর্বিপাকে না পড়ে যায়৷ যেন সংসারের অভাব এই কাজ দিয়ে সামাল দিতে পারে৷ কিন্তু এখন কেউ এই কাজ শিখতে চায় না৷ কেউ কাজ শেখার আগ্রহও দেখায়নি৷ এমনকি আমার দুই মেয়েও৷ তবু এখনও ছাত্রী খুঁজে বেড়াচ্ছি৷


করোনা এবার কেড়েছে দুর্গাপুজোর রং৷ মালদা জেলার অধিকাংশ পুজো উদ্যোক্তা এবার কোনওরকমে পুজো করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ ফলে সমস্যায় পড়েছেন জেলার মৃৎশিল্পীরা৷ হাতে গোনা কিছু নামি শিল্পী ছাড়া কেউই সেভাবে প্রতিমার বরাত পাননি৷ কিন্তু এই পরিস্থিতিতেও রং ছড়াচ্ছেন মহিলা মৃৎশিল্পী যমুনা সরকার৷ গতবারের থেকে এবার বরাতের সংখ্যা বেড়েছে তাঁর৷ আগের বছর বানিয়েছিলেন তিনটি মাতৃমূর্তি৷ এবার বরাত পেয়েছেন চারটি৷ বাইশের সংগ্রামে তিনি এখন মাতৃরূপেণ সংস্থিতা৷


আমাদের মালদা এখন টেলিগ্রামেও। জেলার প্রতিদিনের নিউজ পড়ুন আমাদের অফিসিয়াল চ্যানেলে। সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

বিজ্ঞাপন

Malda-Guinea-House.jpg

আরও পড়ুন

bottom of page