চুপ, গণপিটুনি চলছে
খুঁটিতে বাঁধা প্রায় নগ্ন শরীরটা৷সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও নেই৷এরই মধ্যে ভিড় থেকে ধেয়ে আসছে খিস্তি আর লাথি, ঘুসি৷কেউ ইট দিয়ে থ্যাঁতলে দিতে চাইছে মুখটা৷নাক, মুখ দিয়ে অঝোরে রক্ত পড়তে থাকা ওই যুবক তখন আর কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার অবস্থায় নেই৷ অথচ ভিড় তখনও অশান্ত৷ মার... আরও মার৷ ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ল শরীর৷ খবর পেয়ে যতক্ষণে পুলিশ পৌঁছাল, ততক্ষণে সব শেষ৷ একটা জলজ্যান্ত যুবক তখন শুধু নিথর দেহ৷
সে কি আদৌ চুরি করেছিল কিছু? যদি চুরি করেও থাকে, তাহলেও তাকে পিটিয়ে মারার অধিকার কে দিল? এইসব প্রশ্নের ধার ধারে না ভিড়৷ একটা কাউকে হাতের নাগালে পেলেই হল৷ চোর প্রমাণ করার সময় নেই ভিড়ের৷ মনের মধ্যে জমাট ক্ষোভগুলো চোর সন্দেহে বেঁধে রাখা অচেনা যুবকটির ওপর আছড়ে পড়ল৷ হবিবপুরে বুলবুলচণ্ডীর ডুবাপাড়ায় যে যুবকটিকে চোর অপবাদ দিয়ে সেদিন পিটিয়ে মারা হয়েছিল, তারও তো মানবাধিকার আছে৷
প্রশ্নের ধার ধারে না ভিড়
ভিড় আরও নৃশংস হয়ে উঠেছে৷ আরও বীভৎস হয়ে উঠেছে তার প্রতিহিংসাপরায়ণতা৷ তার প্রমাণ মিলল রতুয়ায়৷ ছোটো মেয়েটা একটা তরমুজ তুলে নিয়েছিল বাজার থেকে৷ চুরিই হয়তো করেছিল সে৷ কিন্তু তরমুজ চুরির পরিণতি এতটা ভয়ংকর হতে পারে, তা স্বপ্নেও ভাবা যায়নি৷ নৃশংসভাবে পিটিয়ে মারা হয়েছিল দুধের শিশুটাকে৷ বছর কয়েক আগের সেই ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল মালদা৷ বাকরুদ্ধ হয়েছিলেন বুদ্ধিজীবীরা৷ নিন্দার ঝড়ে অবশ্য পরিস্থিতি বদলায়নি এতটুকু৷ বরং রতুয়া, হবিবপুরের সঙ্গে এক সারিতে দাঁড়িয়ে গিয়েছে কলকাতাও৷
এনআরএসের কথা মনে পড়ে৷ হ্যাঁ, এই তো কদিন আগেই ডাক্তারদের আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠা এনআরএস৷ সেখানেই নৃশংস পরিস্থিতি হয়েছিল কোরপান শাহ’র৷ সে নাকি হস্টেলে ঢুকে মোবাইল চুরি করে৷ তাকে অবশ্য পুলিশে দেওয়া হয়নি৷ বরং ভিড়ই তার বিচার করেছে৷ থামে বেঁধে বীভৎসভাবে পিটিয়ে মারা হয়েছিল কোরপানকে৷ সে চোর ছিল কিনা, তার প্রমাণ মেলেনি আজও৷ কিন্তু কোরপানকে যারা পিটিয়ে খুন করেছিল তারা যে অপরাধী, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ অথচ কোরপানের পরিবার আজও বিচার পায়নি৷
কখনও ছেলে ধরা, কখনও চোর অপবাদে পিটিয়ে মারার প্রবণতা বাড়ছে৷ হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত যেন গোটা সমাজ৷ দিন কয়েক আগের কথা৷ বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে মারা হয় সানাউল শেখ নামে এক যুবককে৷ ঘটনাস্থল মালদার বৈষ্ণবনগর৷
বল চুরি করেছিস কিনা? কটা মোটরবাইক সরিয়েছিস৷ উত্তর দে ব্যাটা৷ সানাউল চ্যাঁচিয়ে চ্যাঁচিয়ে যতই বলুক, আমি চুরি করিনি, তাতে কর্ণপাত করার কেউ নেই৷ মারতে মারতে ভিড় ক্রমশ উন্মাদ হয়ে উঠছে৷ তরতাজা যুবকটিকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে ফেলে দিতে এতটুকু হাত কাঁপেনি কারও৷
পুলিশ অবশ্য দুইজনকে গ্রেফতার করেছে৷ কিন্তু তাতে তো আর সানাউল ফিরে আসবে না৷ চোর অপবাদে, ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মারার ঘটনায় এখনও আবার বাড়তি সংযোজনা রাজনীতি৷ কোথাও কোথাও ধর্মের আড়ালে রাজনীতির দুর্বল অসহায় মানুষকে খুন করার কৌশল হিসাবে চোর অপবাদ আর গণপিটুনিকে হাতিয়ার করেছে, যার সব থেকে জ্বলন্ত উদাহরণ বৈষ্ণবনগরের সানাউল হত্যাকাণ্ড৷ পরিবারের দাবি, সানাউল চুরি করতে পারে না৷ ওকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয়েছে৷ এর বিচার চাই৷ খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই৷
আসরে নেমে পড়েছে রাজনীতির কারবারিরা৷ সমবেদনার আড়ালে রাজনীতির রুটি সেকতে ব্যস্ত তারা৷ চলছে একে ওপরকে দোষারোপের পালা৷ বৈষ্ণবনগরের বিধায়ক স্বাধীন সরকার স্পষ্ট ভাষায় খুনের নিন্দা করেছেন৷ বলেছেন, চুরি করলে আইন আছে৷ পুলিশ আছে৷ কিন্তু এইভাবে কাউকে পিটিয়ে মারার অধিকার কারোর নেই৷
সানাউল প্রসঙ্গ উঠেছে বিধানসভাতেও৷ জেলা কংগ্রেস সভাপতি তথা বিধায়ক মোস্তাক আলম জিরো আওয়ারে বিধানসভায় বিষয়টি তোলেন৷ গণপিটুনিতে সানাউল শেখের মৃত্যুর ঘটনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আর্জি জানান সরকারের কাছে৷ মোস্তাক আলম বলেন, এফরাজুলের ঘটনার পুনরাবৃত্তি চায় না বাংলা৷ এরপর সানাউলের মৃত্যু রহস্য খতিয়ে দেখতে মালদা এলেন রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান ও পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তীর নেতৃত্বে পরিষদীয় দল৷
ছবি সৌজন্যে পিক্সঅ্যাবে
Comments