কালিয়াচকের কালোনামচা
একদিকে মালদা, অন্যদিকে ঝাড়খণ্ড৷ প্রতিবেশী ওই রাজ্যের সঙ্গে সেঁটে রয়েছে বিহারও৷ মধ্যে স্রোতস্বিনী গঙ্গা৷ মানুষ বলে, গঙ্গায় নাকি সব পাপ ধুয়ে যায়৷ মালদার ক্ষেত্রে সেটা অবশ্য ব্যতিক্রম৷ এই গঙ্গাকে আশ্রয় করেই জেলায় গড়ে উঠেছে দুষ্কৃতীদের এক স্বর্গরাজ্য৷ চোরাপাচারের হাব৷ ভরকেন্দ্র কালিয়াচক৷ অবশ্য রয়েছে বৈষ্ণবনগরও৷ সঙ্গে রয়েছে পুলিশ এবং সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর প্রশ্রয়৷ অন্তত সাধারণ মানুষের বক্তব্য সেটাই৷ তাঁরা আরও জানাচ্ছেন, মাঝেমধ্যে বখরায় ভাটা পড়লে নাকি উর্দিধারীরা জেগে ওঠে৷ তবে এলাকাবাসীর এই অভিযোগ কতটা সঠিক, তা প্রমাণ করার দায় কারোর নেই৷
যাই হোক, এই প্রতিবেদনে মূল আলোচ্য কালিয়াচক৷ উপরের যে ভৌগোলিক অবস্থানের কথা বলা হয়েছে, এই জায়গায় তার সঙ্গে জুড়ে ফেলতে হবে বাংলাদেশকেও৷ ত্র্যহস্পর্শে পোয়াবারো সমাজবিরোধীদের৷ জাল নোট, অস্ত্রশস্ত্র, মাদক, এমনকি মানবপাচারের অভিযোগও জুড়ে গিয়েছে কালিয়াচকের গায়ে৷ কিন্তু গঙ্গার পলিমাখা কালিয়াচকের গায়ে এত কালো দাগ কেন, তা বোধহয় কেউ খুঁজে দেখেনি৷
বেশ কিছুদিন আগে এনিয়ে কথা হচ্ছিল বিএসএফ-এর এক উচ্চপদস্থ কর্তার সঙ্গে৷ মালদা জেলায় বছর দুয়েক ধরে কর্মরত তিনি৷ জানালেন, তিনি নিজেও এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন৷ তাঁর কথায়, কালিয়াচক ও বৈষ্ণবনগর এলাকার মূল তিনটি সমস্যা হল অশিক্ষা, গরিবি আর জনসংখ্যার বিস্ফোরণ৷ সীমান্তবর্তী এলাকার গ্রামগুলিতে প্রবল অর্থাভাবে ভুগছেন ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ৷ এদিকে গড়ে প্রতিটি পরিবারে ৭ থেকে ৮ জন সদস্য৷ এলাকায় কাজের অভাব৷ বেশিরভাগ মানুষ ভিনরাজ্যে শ্রমিকের কাজ করতে যান৷ সেখানেও যা মজুরি মেলে, তাতে সংসার প্রতিপালন অসম্ভব সমস্যার৷ আর ঠিক এই সুযোগটাই কাজে লাগায় চোরাপাচারের আড়কাঠিরা৷ তারা পাচারের টোপ দেয় অসহায় গরিব মানুষগুলিকে৷ আর টাকার লোভে সেই রাস্তায় নেমে পড়েন গরিব মানুষজন৷ তাঁরা তখনও জানতে পারেন না, এটা একমুখী রাস্তা৷ এই রাস্তায় একবার নেমে পড়লে আর ফিরে আসা যায় না৷ প্রথমে অল্প কিছু জাল নোট কিংবা মাদক পাচার দিয়ে হাতেখড়ি হয়৷ পকেটে ঢুকতে শুরু করে কাঁচা টাকাও৷ সেই শুরু৷ টাকার লোভও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে৷ ৩৮ কিলোমিটার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা তখন বেড়ে হয় ৭২ কিলোমিটার৷ সেই সমস্ত পাচারকারীদের ঠাটবাট দেখে চমকে যায় ভালো মানুষের দলও৷ তারাও ধীরে ধীরে এই পথে নেমে পড়ে৷ রিস্ক রয়েছে৷ কিন্তু সামান্য পরিশ্রমে বিশাল আয়৷ তাই এই পথকেই বেছে নেয় এলাকার যুবক থেকে শুরু করে মহিলারাও৷ মাঝেমধ্যে কেউ কেউ পুলিশ কিংবা তাঁদের হাতে ধরা পড়ে বটে, তবে তার সংখ্যা নিতান্তই হাতেগোনা৷
বিষয়টি জানে জেলার রাজনৈতিক মহলও৷ কিন্তু ভোটের ময়দানে অর্থ বড্ড দায়৷ সঙ্গে দায় রয়েছে মাসল পাওয়ারেরও৷ তাই সমাজসংস্কার করা যাদের দায়িত্ব, সেই ব্যবসায়ীরা এইসব লোকজনকেই নিজেদের কাজে লাগায়৷ এভাবেই এগিয়ে চলছে কালিয়াচক৷শরীরে দগদগে ক্ষত নিয়েই৷
আমাদের মালদা এখন টেলিগ্রামেও। জেলার প্রতিদিনের নিউজ পড়ুন আমাদের অফিসিয়াল চ্যানেলে। সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
Kommentare