top of page

গোবরজন্না কালীবাড়ি- ইতিহাস কথা বলে প্রকৃতির আয়নায়

সে এক ভয়ানক যুদ্ধ৷ নামে ও চেহারায় তাঁরা সন্ন্যাসী হলেও আদপে তাঁরা তা নয়৷ যুদ্ধনিপুণ এইসব সন্ন্যাসীদের সাথে নরমগরম কোনোভাবেই এঁটে উঠতে না পেরে ইংরেজ সেনাপতি টমাস এলেন বিরাট সৈন্যবাহিনী আর আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে৷ অপারেশন সাকসেসফুল৷ কিন্তু যুদ্ধাস্ত্র শেষ৷ জয়ের আনন্দে আত্মহারা টমাস আর তাঁর সঙ্গোপাঙ্গোরা কল্পনাও করতে পারেননি যে, মূল শিকারই থেকে গেছে নিশানার বাইরে৷ ফলাফলে নিকেশ টমাস৷ অনেক রক্তের বিনিময়ে জয় এল কিন্তু সমস্যার কাঁটা রয়ে গেল অন্যখানে৷ উদ্দেশ্য এক হলেও বাদ সাধছে ধর্ম, সন্ন্যাসীদের একদল মাদারীপন্থী অন্যদল গিরিপন্থী৷ এই জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে৷ উদ্দেশ্য সাধকের জন্য মিলিত ভাবনার যোগসাজস দরকার৷ তারই সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন দলনেতা ভবানী পাঠক৷ পাশে অবশ্যই চাই আরেক ডাকাবুকো নেতা মজনু শাহকে৷ দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জে তাঁরা মিলিত হলেন৷ শক্তিসঞ্চয়ের আরও উপকরণ চাই৷ জানা গেল, মালদা জেলার রতুয়া অঞ্চলের আড়াইডাঙ্গা গ্রাম যা নাকি বিস্তীর্ণ কালিন্দী নদীর ঘন জঙ্গলে ঢাকা৷ সেখানেই ঘাটি গেঁড়েছেন রাজস্থান থেকে আসা দুর্ধর্ষ একটি ডাকাত দল৷ জলপথে দস্যুগিরিতে তাঁরা এতটাই পারদর্শী হয়ে উঠেছে যে, উত্তরবঙ্গের সমগ্র নদীপথ জলদস্যু কবলিত এলাকা বলে ইতিমধ্যেই চিহ্ণিত৷ ভবানী পাঠকের সঙ্গী তখন আরও এক জমিদার গৃহিণী৷ সমসাময়িক সাহিত্য তাঁর সম্বন্ধে লিখেছে—

‘মন্থনার কর্ত্রী জয়দুর্গা চৌধুরানি

বড়ো শক্তি বড়ো তেজ জগতে বাখানি’

ভবানী পাঠক এই মানস কন্যাটিকে মনের মতো করে বিভিন্ন অস্ত্রচালনায় সুশিক্ষিত করে তুলেছেন৷ নাম দিয়েছেন দেবী চৌধুরানি৷ এরাই চললেন জলদস্যুদের আস্তানা খুঁজে বের করে যোগাযোগ স্থাপন করার উদ্দেশ্য নিয়ে৷ তাতে একদিকে যেমন শক্তি বৃদ্ধি পাবে সন্ন্যাসী যোদ্ধাদের, অন্যদিকে সমগ্র উত্তরবঙ্গ থাকবে তাঁদেরই নিয়ন্ত্রণাধীনে৷ বলা ভালো আরও অজানা জলপথ, জলপথের অজানা আক্রমণের অতর্কিত গতিপ্রকৃতি ইংরেজ জাতির দিনরাতের মাথাব্যথার কারণ হয়ে থাকবে৷ উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার বৈকুন্ঠপুর যাওয়ার পথে সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে ‘দেবী-ভবানী’র সুসজ্জিত নৌকা এসে ভিড়ল এই নদীর খাঁড়িপথে৷ নামলেন ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানি সহ শিক্ষিত লাঠিয়ালের দল৷ দেবী-ভবানীর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ জলদস্যুরা সাদরে বরণ করলেন অতিথিদের৷ জমে উঠল আলাপচারিতা৷ শুধু জলপথে নয় স্থলপথেও চাই যথেষ্ট প্রতিরোধ৷ সেই শিক্ষাই দিলেন ভবানীর শিক্ষিত লাঠিয়ালরা৷


Goborjonna Kali Araidanga
গোবরজন্না কালীবাড়ি- ইতিহাস কথা

এই অঞ্চল তখন নিবিড় জঙ্গল, নিস্তব্ধতায় ভরা, খরস্রোত নদী, হিংস্র শ্বাপদ আর সরীসৃপের অবাধ বিচরণভূমি৷ জনজীবনের কোলাহল থেকে যোজন দূরত্বে এইসব জলদস্যুরা বাস করেন নিজেদের মতো করেই৷ বটগাছের নীচে কালীমাতার বেদিতে রাতের অন্ধকারে পুজো করে তাঁরা বেরিয়ে পড়েন ডাকাতির উদ্দেশ্যে৷ ভবানী পাঠক স্বপ্ন দেখলেন, কালীমাতার শূন্য বেদির উপযুক্ত দেবী অবয়বের৷ ভোর রাতে কালিন্দী নদীর গহন জলে স্নান করে তারই মাটি দিয়ে মূর্তি গড়লেন দেবী কালিকার৷ পুজো করলেন নিজ শরীরের রক্ত দিয়ে৷ রক্ত শপথবাক্য পাঠ করালেন নতুন শিষ্যদের৷ তারপরেই দেবীর বিসর্জনে চিহ্ণ লোপ৷ শক্তি উদ্বোধক দেবী কালীর এই পুজোর ধারাবাহিকতায়, জনপ্রিয়তায় গত তিনশো বছরে যার একটুও ভাঁটা পড়েনি৷ গোবরজন্না কালীমাতা তাই জাগ্রত শক্তির উদ্বোধক৷ আজও কার্তিক অমাবস্যায় দেবী পুজোর বেদি প্রচুর রক্ত উপচারে সাজানো হয়৷ আশেপাশের গ্রাম তো বটেই, দূরদূরান্ত থেকে ভক্ত, সাধারণ মানুষ আসেন অগুনন্তি এই শক্তিপুজোয় অংশ নিতে৷ শুধু কার্তিকী অমাবস্যা কেন, সারা বছরই দেবী পূজিতা হন৷ দেবীর তুমুল জনপ্রিয়তার একটি কারণ যদি হয় কালিন্দী তীরবর্তী প্রাকৃতিক পরিবেশ, দ্বিতীয় কারণ অবশ্যই স্বাধীনতা সংগ্রামের বিতর্কিত ঐতিহাসিক অধ্যায়ের এই এক টুকরো ছোঁয়া৷


আমাদের মালদা এখন টেলিগ্রামেও। জেলার প্রতিদিনের নিউজ পড়ুন আমাদের অফিসিয়াল চ্যানেলে। সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

স্কেচঃ মৃণাল শীল

Comments


বিজ্ঞাপন

Malda-Guinea-House.jpg

আরও পড়ুন

bottom of page