top of page

রেশমি পোশাকের স্বপ্নে জেলাবাসী

নতুন বছর, নতুন আশা৷ আমের গর্বে গরবিনী মালদা৷ কবে থেকে, জানে না কেউ৷ অনেকে আবার এটাও জানে না যে আমেরও আগে এই জেলার গর্ব ছিল রেশম৷ মালদার রেশম একসময় সিল্ক রুট ধরে পাড়ি দিত তিব্বত থেকে শুরু করে একাধিক দেশে৷ একটা সময় এই জেলার রেশম সুতোর তৈরি জামাকাপড় মুঘল বাদশাহ থেকে শুরু করে তাঁদের বেগমদের গায়েও শোভা পেত৷ তার প্রামাণ্য নথিও রয়েছে৷ তবে সেসব এখন সোনালি অতীত৷ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কারণে ভাটা আসতে শুরু করে এই শিল্পে৷ মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেন রেশম চাষিরা৷ এই শিল্পকে ধরে রাখতে সরকারি উৎসাহও তেমন চোখে পড়েনি৷ তবে কয়েক বছর ধরে সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে৷ রাজ্যের বর্তমান সরকারের আমলে খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো শুধু নয়, কার্যত নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটেছে এই শিল্পে৷ এখন মালদার রেশমি সুতো চিন সহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিচ্ছে৷ অন্য দেশগুলির সঙ্গে বাজার দখলের লড়াই চালাচ্ছে৷ ক’দিন আগে এই জেলার প্রাচীন ঐতিহ্য নিস্তারি রেশমের সুতো জিআই ট্যাগও পেয়েছে৷ ফলে এখন মালদার রেশম সুতোকে একটা ব্র্যান্ড হিসাবে বিশ্বের দরবারে পেশ করার চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে৷ কিন্তু এই জেলায় রেশমি জামাকাপড় তৈরি হবে কবে? প্রশ্ন জেলাবাসীর৷


বর্তমানে জেলায় প্রায় ২৩ হাজার একর জমিতে তুঁতের চাষ করা হয়৷ প্রায় ৬৭ হাজার মানুষ রেশম চাষের সঙ্গে যুক্ত৷ প্রতি বছর গড়ে ১৭০০ মেট্রিক টন কোকুন উৎপাদিত হয়৷ প্রায় ছ’লক্ষ মানুষ সরাসরি এই শিল্পে জড়িত৷ এখানে তিন ধরনের রেশম সুতোর উৎপাদন হয়৷ সেগুলি হল নিস্তারি, সাদা রংয়ের বাইভোল্টাইন এবং এই দুই প্রজাতির মিশ্রণে উৎপাদিত এফ-১ প্রজাতির হালকা ঘিয়ে রংয়ের সুতো৷


কিছুদিন আগে পর্যন্ত চিন, জাপান এবং কোরিয়ার উন্নত মানের রেশমের দাপটে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছিল মালদার রেশম৷ মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রাচীন পদ্ধতিতে সুতো উৎপাদন৷ কাঠের ঘাইয়ে তৈরি সুতো একটু মোটা৷ এতদিন এই সুতো বিশ্ববাজারে বাকি দেশগুলির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারত না৷ সেই সমস্যা রাজ্য সরকার দূর করেছে৷ জেলায় নিয়ে আসা হয়েছে মাল্টি এন্ড রিলিং মেশিন৷ প্রতিটি মেশিনে রয়েছে ১০টি এন্ড এবং ১০টি পয়েন্ট৷ অর্থাৎ আগে যে কোকুনে একটি সুতো তৈরি হত, এবার সেই কোকুনে ১০০টি সুতো তৈরি হচ্ছে৷ সেই সুতো অত্যন্ত পাতলা৷ এই মিহি সুতোই এবার বিশ্ব বাজারে চিন-জাপান-কোরিয়াকে পাল্লা দিচ্ছে৷


মালদা জেলায় বছরে পাঁচটি রেশম উৎপাদনের মরশুম৷ কালিয়াচকের রেশমচাষি মহম্মদ সুফিয়ান আলি বলছেন, ‘এবার ফাল্গুনি মরশুমে আবহাওয়া খুব ভালো থাকায় বাম্পার ফলন হয়েছে৷ স্থানীয় রেশমের দাম প্রতি মনে (৪০ কিলো) ১৯ থেকে ২১ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছে৷ সবচেয়ে ভালো ফলন হয়েছে চাঁচল এলাকায়৷ সেখানকার গুটি ২৪ হাজার টাকা মন দরেও বিকিয়েছে৷ অন্যান্য মরশুমে এর দাম ১৬-১৭ হাজারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে৷ আমরা সাধারণত প্রতি বিঘায় দু’কুইন্ট্যাল ফলন পাই৷ এবার  ১০ কিলো বেশি ফলন পেয়েছি৷’



শেরশাহী বসনিটোলার লালু শেখ নিজে রিলার (সুতো প্রস্তুতকারক) এবং ব্যবসায়ী৷ তাঁর বক্তব্য, ‘এবার ব্যবসা খুব ভালো হচ্ছে৷ এই মরশুমে কোকুনের দামও বেশ ভালো ছিল৷ আমরা প্রতি মন কোকুন ২০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ২৪ হাজার টাকা দরে কিনেছি৷ এখন প্রতি কিলো সুতোর দাম চলছে ৩৭০০ থেকে ৪২০০ টাকা৷ এই এলাকার রেশম এখন বারাণসী, মোবারকপুর, গুয়াহাটিতে বেশি বিক্রি হচ্ছে৷ অবশ্য আরও অনেক রাজ্যে এখানকার সুতো যায়৷ মাল্টি এন্ড মেশিনের সুতোর চাহিদা খুব ভালো৷ এই মেশিনের সুতো বিদেশেও যায়৷ আরও বেশি পরিমাণে সুতো বিদেশে যেতে শুরু করলে এই শিল্পে মানুষের উৎসাহ আরও বাড়বে৷’


রেশম শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকেই বলছেন, এই শিল্পের অভ্যুত্থানের পিছনে হাত রয়েছে মোথাবাড়ির বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিনের৷ মূলত তাঁর উদ্যোগেই সবকিছু হয়েছে৷ এনিয়ে প্রশ্ন করা হলে সাবিনা বলেন, ‘একটা সময় মালদার গর্বের রেশম শিল্প কার্যত মৃত হয়ে পড়েছিল৷ মন্ত্রী হওয়ার পর এই শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে সেরিকালচার বিভাগের কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করি৷ জেলায় রেশম চাষের পরিধি বাড়াতে প্রতি মাসে ওই দফতরে তিন থেকে চারটি চিঠি দিয়েছি৷ আমাকে প্রথম থেকে উৎসাহ দিয়ে চলেছেন সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ও৷ শেষ পর্যন্ত কাজ হয়৷ জেলায় রেশম চাষের পরিধি বাড়ার পাশাপাশি উৎপাদন বেড়েছে৷ বেড়েছে দামও৷ রাজ্য সরকার এখন রেশমচাষি থেকে শুরু করে এই শিল্পে জড়িত সবাইকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করছে৷ এখন মালদার রেশম সুতো বিদেশের বাজারে জায়গা নিচ্ছে৷ এটা খুব আনন্দের বিষয়৷


প্রথম থেকেই আমার মনে একটা প্রশ্ন ছিল, যদি মুর্শিদাবাদ সিল্ক ব্র্যান্ড হতে পারে তবে মালদার সিল্কের সেই ব্র্যান্ড হবে না কেন? মুর্শিদাবাদে তো গুটিপোকার চাষও হয় না৷ যাই হোক, অবশেষে সেই জায়গায় আমরা যেতে পেরেছি৷ এখন চিন সহ বিভিন্ন দেশে এখানকার রেশম সুতো যাচ্ছে৷ সেরিকালচার বিভাগ এবং মন্ত্রীর সহযোগিতা পেলে মালদার রেশম চাষ আমরা আরও ভালো জায়গায় নিয়ে যেতে পারব৷ মালদা জেলা যে রেশম শিল্পের জন্য বিখ্যাত, সেটা কথায় নয় কাজে প্রমাণ করে দেখাব৷ আপাতত আমরা মৃতপ্রায় রেশম শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে পেরেছি৷ এরপর আমার টার্গেট এই জেলাতেই রেশমি জামাকাপড় তৈরি করা৷ এনিয়ে আমি সেরিকালচার দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, এমনকি মুখ্যমন্ত্রীকেও বোঝানোর চেষ্টা করব৷ যেহেতু এই শিল্প এখন লাভজনক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে, তাই এখানে কেন আমরা মালদা ব্র্যান্ডের রেশমি শাড়ি কিংবা জামাকাপড় তৈরি করতে পারব না? নিশ্চয়ই পারব৷’


আমাদের মালদা এখন টেলিগ্রামেও। জেলার প্রতিদিনের নিউজ পড়ুন আমাদের অফিসিয়াল চ্যানেলে। সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

Comments


বিজ্ঞাপন

Malda-Guinea-House.jpg

আরও পড়ুন

bottom of page