বড়োদিন, উৎসব, এবং ফালতুর দল...
দক্ষিণায়ন শুরু হল। আজ বড়োদিন। আগের রাতে যিশুর কান্নার রোলে ভরে উঠেছিল আস্তাবল। একুশের ঠিক সেই রাতেই উদ্বাহু নেত্য শুরু হয়েছে মালদা শহরের সাত থেকে সত্তরের। কী ! নাকি শহরে তৈরি হয়ে গিয়েছে ভালোবাসার এমব্লেম। কারও মতে নিজস্বী ক্ষেত্র। তাই মাঝরাতেও শুভঙ্কর বাঁধে চলেছে নজরদারি। কেউ বা সেই রাতেই মুঠোফোনে অন্ধকারের আলো বাঁধে নিজেদের উপস্থিতি ধরে রেখেছে।
এই বাংলায় দশক কয়েক আগেও বড়োদিন ছিল নলেন গুড়ের পায়েস, পাটিসাপটা কিংবা তেমনই আরও কিছুতে। সবটা রসে মাখামাখি। পুরোপুরি বাঙালিয়ানা। তখন শীতের আমেজ শরীর আরও ভালো টের পেত। কুয়াশা জড়িয়ে থাকা সকালে হাঁক শোনা যেত শিউলির। দাঁতে দাঁত চেপে ঢকঢক। আরব দেশের রস সেঁধিয়ে যেত বাঙালি পাকস্থলীতে। তখন হাতে গোনা দু’চারটি বেকারি তৈরি করত কেক। পরিবারের কর্তা বিকেলে বাড়ি ফেরার সময় খবরের কাগজে মোড়া সেই কেক নিয়ে যখন দরজার শিকল ঝাঁকাতেন, ঘরের ভিতর ছোটদের মনে তখন খাই খাই সুনামি।
এখনও অনেক বয়স্ক আক্ষেপ ইতিউতি ঘুরে বেড়ায় শহর জুড়ে। বাঙালি আর বাঙালি নেই। যিশুর জন্মদিনে তাই শুভ বড়োদিন এখন মেরি ক্রিসমাস। বাঙালি ছেলেমেয়েরা এখন বাংলা ছেড়ে ইংরেজিতে অভ্যস্ত হচ্ছে। নতুন বাংরেজি ভাষার প্রবর্তন হয়েছে। আটের ভাষা এখন আশির মুখেও। বড়োদিনে পিঠে-পায়েস আর কই ! গোটা শহরে কেক-পেস্ট্রির ছড়াছড়ি। ইংল্যান্ডের খাবারে এখন ভাগ বসাচ্ছে ইতালি-আমেরিকাও। পিৎজা-ফ্রায়েড চিকেনের নামে এখন বাঙালির আর জিভে জল আসে না। জামা ভেজে। একসময় একটি বহুজাতিক কোম্পানির বিজ্ঞাপন ‘পুজোয় চাই নতুন জুতো’ মানসে সাড়া ফেলেছিল। সেই বিজ্ঞাপন আবারও ফিরে এসেছে। তবে একটু আলাদা ভাবে, ‘দাবি আমাদের মানতেই হবে, নতুন স্মার্টফোন দিতে হবে’। শুধুই কি জেন ওয়াই ! জেন এক্সের মনও এখন উসখুস করে বছরভর। এই একটি ক্ষেত্রে এক্স-ওয়াই একাকার।
তা হোক। বিজ্ঞানের সঙ্গে দৌড়োতে হবে সবাইকেই। নইলে আবার পিছিয়ে পড়তে হবে। তাই আগে যেসব জ্যাঠা-বাবাদের সবসময় রাশভারি থাকতে দেখা যেত, এখন তাঁরা পেরেস্ত্রৈকার হাওয়ায় দুলে ওঠেন। সেই দোলার ছোঁয়া লাগে বারান্দা, অন্দরমহল পেরিয়ে এক্কেবারে হেঁশেলেও। বিজ্ঞান কবেই উনুন সরিয়ে দিয়েছে। গ্যাস ওভেনও এখন পড়তির মুখে। আগুনের আঁচ থেকে স্যাঁলোয় চকচকে মুখের পালিশ ঠিক রাখতে এখন ঘরে ঘরে ইনডাকশন কিংবা মাইক্রো ওভেন। যেন ফিল ইট, শাট ইট, ফরগেট ইট।
এত কিছু পালটালে বড়োদিন পালটাবে না কেন? উৎসব এখন কার্নিভাল। কিন্তু দুগ্গাপুজোর মতো এই উৎসবে প্রতিমা কোথায়? মা মেরির মূর্তি আছে বটে, কোলে আবার যিশুও রয়েছেন। কিন্তু সে কি দুগ্গা মায়ের মতো সাজানো ! তাই শহর জুড়ে আলোর মালা। কম্পিটিশনের যুগে কে এগিয়ে, কে পিছিয়ের তাড়ায় শহর তোলপাড়। এক নয়, একাধিক আয়োজন। আজ থেকে শহরে যান নিয়ন্ত্রণ। সরকারিভাবেই। হবে নাই বা কেন? মানুষ এখন নাকি আনন্দে ভাসতে চায়। তা ঘরে খাবার থাক আর নাই থাক। উৎসব আগে। আর পকেটের চিন্তা করে কে ! রিকশা অথবা টোটো-অটো চালকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টেও তো ঢুকছে টাকা। রাস্তার ধারে খাবারের দোকানদার, ফেরিওয়ালা কিংবা তেমন মানুষজনও উপরওয়ালার সেই দান থেকে বঞ্চিত নয়।
উৎসব থাকবে, আনন্দ থাকবে, আর নিজস্বী থাকবে না, তা কি হয়? তাই শুভঙ্কর বাঁধ এখন একটুকরো হলিউড, কিংবা কালিম্পং। ‘আই লাভ মালদা’ মোড়কে এখন ভাসছে শহর। প্যাকেজিং আর মার্কেটিংয়ের যুগই বটে। তাই অনেক পিছিয়ে গিয়েছে বর্ষার জল যন্ত্রণা, আর্সেনিক মিশে থাকা বিষজল পান কিংবা শহরের যানজটের মতো ফালতু সমস্যাগুলো। মানুষ এখন উৎসবের দাস। বড়োদিন পেরোতে না পেরোতেই চলে আসবে বর্ষবরণ উৎসব। ঠিক তারপরেই চলে আসছে আরও বড়ো উৎসব। ভোট উৎসবে শহরের সেই ফালতু সমস্যাগুলো মাথা চাগাড় না দিলেই হয়।
আমাদের মালদা এখন টেলিগ্রামেও। জেলার প্রতিদিনের নিউজ পড়ুন আমাদের অফিসিয়াল চ্যানেলে। সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
Comments