ভিড় যখন নিজেই চরিত্র
top of page

ভিড় যখন নিজেই চরিত্র



পশ্চিমবঙ্গের এক প্রত্যন্ত গ্রামে ছিলাম যখন ফেসবুক বাহিত হয়ে খবরটা এসে পৌঁছল৷ কাশ্মীরে সেনাবাহিনীর কনভয়ে গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে নিহত বহু৷ মৃত্যুর খবর সাধারণত খুব প্রকট শোনায় কানে৷ অন্য আর পাঁচটা খবর ঠিক অতটা নয়৷ কেন এরকম হয় কে জানে! হতে পারে মৃত্যু ঠিক যতটা সত্য, অন্য আর পাঁচটা জিনিস বোধহয় অতটা না৷ প্রশ্ন মাথায় আসে সত্যতা বা সত্য নিজে ঠিক কি?

এই দার্শনিক প্রশ্ন নিয়ে পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্যের দার্শনিকরা বহুদিন ধরে বহু আলোচনা করেছেন৷ দর্শনের কৌতূহলী ছাত্র মাত্রেই জানেন সত্যকে বিশ্বাস রূপে দেখা করেসপন্ডেস তত্ত্ব আর বিশ্বাসগুলির মধ্যে সামঞ্জস্য রূপে দেখা কহিয়রেন্স তত্ত্বের কথা৷ এই আলোচনারই এক পর্বে মার্কিন দার্শনিকরা মোক্ষমভাবে বললেন, যা কাজে লাগে তাই সত্য৷ অর্থাৎ সত্য একটা প্রয়োগবাদ৷

অতি সরলীকরণ হলেও সেই অর্থে জঙ্গিহানায় এই এতগুলো মৃত্যু একটা বড়োসড়ো সত্য, শুধু ক্রমবর্ধমান জিহাদি-র সংখ্যা বা ভারতবর্ষের বুকে বেড়ে চলা আতঙ্ক নয়৷ কারণ শুধু আতঙ্ক এখন আর আমাদের সেভাবে নাড়া দেয় না, ভাবিয়ে তোলে না৷ আর যা আমাদের নাড়া দেয় না, তা বাজার অর্থনীতির যুগে মিথ্যা৷ এই মৃত্যু আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে৷ আমাদের দেশপ্রেম একটা মাধ্যম পেয়েছে তাকে প্রকাশ করার৷

ফেসবুক থেকেই খবর আসে৷ দেখলাম যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ কীভাবে ফুঁসে উঠেছেন৷ ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে বোধহয়৷ উচিত ও তাই৷ চাক্ষুষ করলাম৷ এই প্রত্যন্ত গ্রামেও৷ বেশ পরিমাণ মানুষ নেমে এসেছেন রাস্তায়৷ জায়গায় জায়গায় ‘পাকিস্তান মুর্দাবাদ’ স্লোগান উঠছে৷

এই ফুঁসে ওঠা অভূতপূর্ব৷ দেশের গরিমায় আঘাত লাগতে পারে এমন কোনো কথা শুনলেই মানুষ রে রে করে তেড়ে যাচ্ছে৷ ফেসবুকে বিরূপ পোস্ট ভেসে যাচ্ছে কদর্য মন্তব্যের বন্যায়৷ সেই দেখে কেউ কেউ আবার ‘আনফ্রেন্ড’ও করে দিচ্ছে৷ কেউ বিরক্তি সয়েও চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে ভিন্নমতের আঙিনায়৷ আশ্চর্য লাগে এখনও এমন মানুষ আছেন যিনি সন্ত্রাসে ধর্ম দেখতে পান না৷ বিনা বিচারে বেহেস্তে প্রবেশের ছাড়পত্র পাবার লোভে জিহাদি-রা বিধর্মীদের খুন করলেও! এরাই আবার গো-রক্ষার নামে পুলিশ খুন হলে উগ্র হিন্দুত্ববাদ দেখতে পান৷ ঘৃণ্য দুটোই, যদিও৷ ভারতও ইতিমধ্যেই পাকিস্তানকে ‘আনফ্রেন্ড’ করে দিয়েছে৷

ক্রমবর্ধমান ভিড়ের সন্নিকটে দাঁড়িয়ে একথা ভাবছিলাম৷ এক্ষুনি কেউ ভিড়ের ভেতর পাকিস্তানের পতাকায় আগুন দিল৷ দাউদাউ করে জ্বলে ওঠা আগুনে মুখগুলি দেখলাম, আমারই দেশের সবখেটে খাওয়া মানুষ, চাকরিজীবী, চাকরিদাতা, ব্যবসায়ী, ক্রেতা, ভোক্তা, উপভোক্তা, দালাল, কত বলব! স্লোগান উঠল - হিন্দুস্থান জিন্দাবাদ৷ স্লোগান উঠল- বদলা চাই!

আমরা বলি আর না বলি, পাশে থাকি আর না থাকি - সেনাবাহিনী তার কাজ করবেই৷ তবু এই দেশপ্রেমের নতুন জোয়ার দেখে মনে হয়, আহা, এ যদি এই পর্বে আমাদের কিছুটা চিত্তশুদ্ধিও ঘটাতে পারত৷ ভিড়ের বাইরে বেরলে তো আমরা আবার যে কে সেই- কপট, তঞ্চকতাপ্রিয়, চৌর্যবৃত্তি জারিত, প্রবৃত্তি চালিত এবং সর্বোপরি আত্ম বিস্মরণশীল ব্যক্তি বিশেষ৷ কেবল নিজ স্বার্থটুকু সিদ্ধির যে ‘জিহাদ’ আমরা অবচেতনে পুষে রেখেছি, তাকে নিকেশ করবে কোন সেনাবাহিনী! গাড়িবোমা বাঁধার দরকার পড়ে না আমাদের, কেবল ক্ষমতার নিকৃষ্ট পদলেহনেই আমরা উড়িয়ে দিতে পারি বিরোধীদের৷

ভিড়ের ভেতর থেকে স্লোগান উঠে- এ হত্যালীলা আমরা ভুলব না! জানি না৷ সত্যিই কি তাই! ক’মাস বাদেই ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ নিয়ে আমরা না আবার হইহই করে মেতে উঠি৷ নিশ্চিন্ত, খেলা হলে মাঠে একটাও আসন ফাঁকা পড়ে থাকবে না৷ টিভি-র সামনে বসে থাকবে রেকর্ড সংখ্যক লোক৷ সেদিন আমাদের সৈনিকরা জলপাই রং-এর পোশাকের পরিবর্তে পরবে নীল আর বন্দুকের বদলে হাতে থাকবে ব্যাট৷ আমরা সেই দাঁড়িয়েই থাকব হাতে আগুন আর পতাকা নিয়ে৷ ভারত জিতলে পুড়িয়ে দেব পাকিস্তানেরটা৷ আর না জিতলে?

স্কেচঃ মৃণাল শীল।

বিজ্ঞাপন

Malda-Guinea-House.jpg

আরও পড়ুন

bottom of page