যেখানে ভূতের ভয়
বছরে ভূতেদের একটিমাত্র উৎসব৷ বাংলায় ভূত চতুর্দশী আর বিদেশে হ্যালোউইন৷ দুটোই প্রায় একইসময়...
‘ভূত আমার পুত, পেতনি আমার ঝি, রাম-লক্ষ্মণ আছে সাথে, করবি আমার কী?’ ছেলেবেলায় যখন ভূতের ভয় পেতাম জোরে জোরে এই ছড়াটা আউরে যেতাম৷ভূত শব্দটির মধ্যে একটা গা ছমছমে অনুভূতি, রোমাঞ্চ, আবার আকর্ষণও জড়িয়ে কুড়িয়ে আছে৷বৃষ্টিঝড়া রাত, তেলেভাজা দিয়ে মুড়িমাখা আর ভূতের গল্প আর কী চাই? ভয়ংকর, ভূত৷ অমাবস্যার রাতে হানা বাড়িতে গিয়ে রাত কাটানো মানুষটির এমন ভীষণ ভূতের পাল্লায় পড়ল পরের দিন আর প্রাণ নিয়ে ফিরে এল না৷অন্ধকার ঘুটঘুটে রাতে শ্মশানে একা গিয়ে নরখুলি হাতে নিয়ে ফিরে আসা মানুষও বিরল নয়৷রেললাইনে আত্মহত্যা করা ভূতেরা কবন্ধ হয়ে রাতে প্রকট হয়৷বড়ো বড়ো রেল দুর্ঘটনায় প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়৷ যেখানে হয় সেখানে রাতবিরেতে ভূতেদের উপদ্রবের হাত থেকে বাঁচার জন্য দেখা গেছে, রেল কর্তৃপক্ষ বিকল্প রেললাইন বসিয়েছেন৷মজার ভূতের গল্পও আছে৷ তালগাছ থেকে শাঁকচুন্নি নেমে এসে পালকি থেকে নতুন বউকে উঠিয়ে তালগাছের উপর রেখে নিজে বউ সেজে নতুন সংসার করতে লাগল৷একদিন শাশুড়ি-মা দেখেন ছেলের বউ দুপা উনুনে ঢুকিয়ে দিয়েছে৷দাউ দাউ করে দু-পা জ্বলছে আর উনুনে রান্না হচ্ছে৷দেখে তো শাশুড়ি মা ভিরমি খেলেন৷ওঝা ডেকে সরষে পোড়া মেরে শাঁকচুন্নিকে তাড়িয়ে বউকে উদ্ধার করলেন৷কর্তা মাছ বাজার থেকে ইয়া বড়ো পদ্মার ইলিশ কিনে হাতে ঝোলাতে ঝোলাতে বাড়ি ফিরছেন৷পিছু নিল এক মেছো পেতনি- এ্যাই আঁমাকে মাঁছ দিঁয়ে যাঁ৷নঁইলে তোঁর ঘাঁড় মঁটকে খাঁব৷ইলিশ ফেলে কর্তা বেদম ছুট লাগালেন৷অমাবস্যার নিকষ কালো রাতে বাঁশবাগানে ভূতদের জলসা নাচা-গানা-ভোজের আসর৷মেনু হচ্ছে পচা গলা মাছ, মাংস, মাছের পিত্তি, ইঁদুরের ঝোল, কেঁচো ভাজা, ব্যাঙের ঝোল৷ ওদিকে এক বাঞ্ছাবুড়োই তো বারে বারে জমিদার ব্রেহ্মদত্যিকে বোকা বানিয়ে ফল-ফুলওয়ালা সরেস বাগানটি সপরিবারে ভোগ করতে থাকল৷গুপিগাইন বাঘাবাইনের ভালো ভূতের রাজার তিন বরে গুপী বাঘা নায়ক হয়ে দেশবিদেশ মাত করে দিল৷
এক রাতে মার্থা মেমসাহেব আত্মহত্যা করলেন
কালীপুজোর অমাবস্যার রাত ভয়ানক৷দীপাবলিতে অমনিশা দূর হয়৷মেডিকেল কলেজ হস্টেলের ডাক্তারেরা ভারী নাস্তিক৷অহনা, রিয়া, অংশুমান, দীপ আর অর্ণব প্ল্যান করল কালিম্পং-এর মরগ্যান টি-গার্ডেনের বাংলোয় ভূত চতুর্দশীর রাত অর্থাৎ কালীপুজোর আগের রাতে থাকবে৷বহুদিন আগে মরগ্যান সাহেব একটি বিরাট চা বাগান কিনেছিলেন৷তাঁর স্ত্রী মেমসাহেব মার্থা আর তিনি বাস করতেন৷সেখানে রমরমিয়ে বাগান চলত৷এমন অবস্থায় এক রাতে মার্থা মেমসাহেব আত্মহত্যা করলেন৷কিছুদিন পরে ভালো মানুষ মরগ্যান সাহেবও মারা যান বাংলোতে রহস্যজনকভাবে৷টি-গার্ডেনও বন্ধ হয়ে যায়৷প্রায় বছর খানেক আগে অহনার বাবা রেঞ্জার হয়ে কালিম্পং-এ আসেন৷অহনা বেশ কয়েকবার এখানে এসে মরগ্যান সাহেবের বাংলোর গল্প শুনেছিল৷এখন তারা দল বেঁধে এখানে এসে পৌঁছল৷অহনার বাবার বাংলোতে দুপুরে ফ্রেস হয়ে খাওয়াদাওয়া করে মরগ্যান সাহেবের ওয়াচম্যানের কাছ থেকে বাংলোর চাবি নিয়ে ওরা বাংলোতে ঢুকে পড়ল সন্ধেবেলায়৷জমিয়ে আড্ডা মারার প্ল্যান ওদের৷ভূতে বিশ্বাস নেই ওদের কারোর৷
রিয়া অবাক হয়ে দেখল অহনার চোখ দুটো নীল
বাংলোতে ঢুকে ওরা অবাক৷এতো সুন্দর মেহগনি কাঠ দিয়ে বানানো ওয়েলফার্নিশিড বাংলো, সুন্দর একটি পিয়ানোও আছে ড্রইংরুমে৷বোঝা যাচ্ছে মার্থা মেমসাহেবের পিয়ানো বাজানোর শখ ছিল৷কিছুক্ষণ আড্ডা মারার পর অহনা আর রিয়া হঠাৎ উঠে বাংলো ঘুরে দেখতে গেল৷একটা বন্ধ ঘরের কাছে এসে ওরা কৌতূহল দমন করতে না পেরে ধাক্কা মারতেই একটা ঠান্ডা হাওয়ার ঝলক এল৷দরজাও খুলে গেল৷ওদের গা শিরশির করে উঠল৷ঘরে ঢুকে সব হাবিজাবি জঞ্জালের মধ্যে ওরা একটি কফিন দেখতে পেল৷হঠাৎ কফিনটা নিজে থেকে খুলে গেল৷এক মেমসাহেব বের হলেন কফিন থেকে৷ওরা পিছু সরতে সরতে অহনা একটা পেরেকওয়ালা তক্তার উপর পরে গিয়ে হাত কেটে রক্ত বের হতে লাগল৷মেমসাহেব অহনার দিকে লম্বা হাত বের করে দিয়ে বলতে লাগলেন চিৎকার করে- ‘আই লাইক ব্লাড’৷ হঠাৎ মেমসাহেব উধাও হয়ে গেলেন৷রিয়া অবাক হয়ে দেখল অহনার চোখ দুটো নীল, ঠিক মেমসাহেবের মতো৷মেমসাহেব মার্থা রিয়ার দিকে হাত বাড়াল৷রিয়া ওর মায়ের দেওয়া মা-কালীর সোনার লকেটে হাত দিয়ে চিৎকার করে দীপ, অংশুমান, অর্ণবদের ডাকতে লাগল৷হুড়মুড় করে ওরা ওখানে এসে পড়ল এবার মেমসাহেব খুব ফরসা দীপের দিকে ছুটে গেল- অহনা, মেমসাহেবের গলায় বলতে লাগল- ওহ জন ওহ জন হোসাই ইউ চিটেম মি মাই লাভ৷আ উইল ফলো ইউ৷ দীপ প্রাণপণ দৌড়তে লাগল৷অহনাও ওর পিছু নিল৷সকলে অহনা অহনা করে ডাকতে লাগল৷হঠাৎ চারিদিকের নিস্তব্ধতা খানখান করে দীপের মরণ চিৎকার ভেসে এল৷ওরা দৌড়ে বাইরে বেরোতেই দেখল দীপের রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন দেহের পাশে হাঁটু গেড়ে অহনা বসে আছে৷আর হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলছে- বিশ্বাস কর আমি দীপকে মারিনি৷আমাকে কে যেন দীপকে মারতে জোর করল৷ওরা তিনজন দীপ আর অহনার এরকম অবস্থা দেখে ভীষণ ভেঙে পড়ল৷পুলিশ এল, দীপের বাবা-মা এলেন৷একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে ওদের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না৷বলার অপেক্ষা রাখে না মরগ্যান সাহেবের স্ত্রী মার্থার সাথে প্রেমের অভিনয় করে জন পালিয়ে যায়৷হতাশায় মার্থা আত্মহত্যা করেন৷ অহনার এক মাস জেল হয়৷তারপর অহনাকে জেল হাসপাতালে ভরতি করতে হয়৷আজও মরগ্যান সাহেবের চা বাগানের বাংলোতে মার্থার ভূত ঘুরে বেড়াচ্ছে দু-চোখে প্রতিহিংসার আগুন নিয়ে৷
Comments