নীল তিমির ত্রাস
top of page

নীল তিমির ত্রাস

২০১৩ সাল, দেশ রাশিয়া৷ ভিকনটাকটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কে আত্মপ্রকাশ করল একটি ‘ডেথ গ্রুপ’- যার প্রভাবে প্রথম আত্মহত্যাটি ঘটে গেল ২০১৫ সালে৷ রাশিয়ার প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজির ছাত্র ফিলিপ বুডেইকিনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল৷ বহিষ্কৃত হওয়ার পর তিনি জম্পেশ করে এই নীল তিমির মারণ খেলায় মেতে উঠেছিলেন।


তিনি বিশ্বাস করতেন সমাজে যারা হতাশ তাদের পাশে কেউ নেই৷ অসহায় সেই বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেমেয়েদের পৃথিবীতে বাঁচার কোনো প্রয়োজন নেই৷ সমাজে তাদের কোনো মূল্যবোধও নেই৷ সুতরাং সমাজ থেকে এদের মুক্ত করে দিতে হবে৷ তাদের বেছে নিতে হবে আত্মহত্যার রাস্তা৷ জীবনের এই আত্মহত্যার কঠিন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে তাদের৷



ব্লু-হোয়েল গেম হচ্ছে ব্লু-হোয়েল চ্যালেঞ্জ৷ একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের মারণ খেলা হচ্ছে ‘নীল তিমি খেলা’- এই খেলায় একজন অ্যাডমিনিস্ট্রেটর থাকেন, তিনিই নির্দেশ পাঠান অনলাইনে কখন কী করতে হবে৷ ধাপে ধাপে অত্যন্ত বাধ্যভাবে প্রায় উনপঞ্চাশটি নির্দেশ পালন করার পর খেলোয়াড়ের কাছে শেষ নির্দেশটি অর্থাৎ পঞ্চাশতম নির্দেশটি আসবে আত্মহত্যা করার৷ খেলোয়াড় নির্মমভাবে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হাতে একটি নীল তিমির ছবি ফুটিয়ে তুলবে তারপর সাহসিকতার সাথে উঁচু স্তম্ভ, সেতু, উঁচু বহুতলের ছাদ অথবা ট্রেন লাইনে ঝাঁপ দেওয়ার মতো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেন৷ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর মিউজিক ও ভিডিয়ো ক্লিপস-এর মাধ্যমে খেলোয়াড়দের কাছে নির্দেশাবলী পাঠাতে থাকেন ধাপে ধাপে৷

২০১৬ সালে রাশিয়ার এক প্রখ্যাত সাংবাদিক টিনএজারদের আত্মহত্যার ঘটনাবলীর সাথে এই খেলার একটি সংযোগ খুঁজে পান৷ এই নীল তিমি খেলাটি তখন সর্বসমক্ষে বহুলভাবে প্রচারিত হয়৷ এই সময় ১৬ জন বয়ঃসন্ধির মেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় এই খেলায় মেতে৷ ব্যাপকভাবে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এই ব্লু-হোয়েল গেম৷ চিনে ‘হিউম্যান এমব্রয়ডারি’ নামে আত্মহত্যার সাথে এই খেলার মিল পাওয়া যায়৷ আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে, পর্তুগাল, কেনিয়া, সৌদি আরব, সার্বিয়া, বুলগেরিয়া, চিলি, চিন, কলম্বিয়া, জর্জিয়া, ইটালি, ভারত, স্পেন, ইউনাইটেড স্টেটস, ভেনেজুয়েলা, উরুগুয়ে সর্বত্র আগুনের মতো ছড়িয়েছে এই মৃত্যু ফাঁদ অর্থাৎ মারণ খেলা৷

ইতিমধ্যে ফিলিপ বুডেইকিনকে দোষী সাব্যস্ত করল রাশিয়ার একটি সংবাদমাধ্যম এই খেলার ‘মাস্টার মাইন্ড’ হিসেবে৷ কারণ তার তত্ত্ব হচ্ছে টিনএজাররা হতাশ- শারীরিক ও মানসিকভাবে ব্যর্থ৷ তাদের সমাজ থেকে আবর্জনা হিসেবে পরিষ্কার করে দাও৷ ১৬ জন টিনএজার কন্যার আত্মহত্যার দায়ে তাকে অ্যারেস্ট করা হল৷ ২৬ মে ২০১৭ তে রাশিয়ার ডুমা অর্থাৎ পার্লামেন্টে একটি বিল পাস করল ব্লু-হোয়েল সাইটের বিরুদ্ধে৷ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ২০১৭-র ৭ জুন আইন প্রণয়ন করলেন, ব্লু-হোয়েল খেলায় যুক্তরা ধরা পড়লে ছয় বছর কারাদণ্ড হবে৷ ৪ জুন মস্কো শহরে ধরা পড়ল এই মারণ খেলার আর একজন নির্ণায়ক৷

বিদ্যালয়-কলেজ, শহর থেকে শহরতলী, ঘরের আনাচেকানাচে মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়িয়েছে ব্লু-হোয়েল গেমের ভয়াবহতা সম্বন্ধে৷ বিশ্বের প্রযুক্তিগত ও আর্থ-সামাজিক দূষণের মধ্যে এই মারণ খেলার বীজ লুকিয়ে আছে৷ বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েরা আজ কেন এত হতাশ? যতদিন এই হতাশার কারণ অনুসন্ধান করা যাবে না ততদিনই আমাদের দেখতে হবে ভয়ংকর সব মৃত্যু৷ প্রযুক্তিগত ব্যবহারের খারাপ দিক বন্ধ করতে হবে৷ প্রশাসনিকস্তর থেকে এই নিয়ন্ত্রণ জারি করতে হবে৷ অভিভাবকদের অনেক বেশি সচেতন হতে হবে ছেলেমেয়ের গতিবিধি ও কার্যকলাপের উপর৷ সর্বোপরি তাদের মনের খবর রাখতে হবে বন্ধুত্বের মাধ্যমে৷ সন্তানদের যথেষ্ট সময় দিতে হবে৷ বিদ্যালয়গুলির শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনেক বেশি সচেতন হতে হবে৷ ছাত্রছাত্রীদের সৃজনশীল কাজকর্মের সাথে যুক্ত করতে হবে৷ যাতে এই বয়সের ছাত্রছাত্রীরা হতাশার ঘেরাটোপে নিজেদের বদ্ধ করতে না পারে৷ ভালোভালো কাজ করার স্বপ্ন তৈরি করতে হবে যৌবনে পদার্পণ করার প্রাক মুহূর্তে সন্তানদের মনে৷ ব্যর্থ প্রাণের মনের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে জ্ঞানের আলো জ্বালাতে হবে৷ সকলে মিলে এই মারণ খেলা বন্ধ না করতে পারলে আমাদের একটি করে অনভিপ্রেত মৃত্যুর অপেক্ষা করতে হবে৷ শুনতে হবে কেরালার ১৬ বছরের ছাত্রের মৃত্যু, মুম্বই-এর ১৪ বছরের ছেলের পাঁচতলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যু, শুনতে হবে আমাদের পাশের বাড়ি বারাসতের ছাত্রের মৃত্যুর ঘণ্টাধবনি৷ কারণ মৃত্যু এখন আমাদের বাড়ির আনাচেকানাচে-ছাদের কার্নিশে৷ ‘মৃত্যু ছেঁড়া মাদুরে’ (পাবলো নেরুদা) - এ মৃত্যু ইচ্ছামৃত্যু৷ মৃত্যুর চেয়ে ইচ্ছামৃত্যু অনেক বেশি ভয়ংকর কারণ এই মৃত্যুর আওয়াজ কিছুটা গিমিক তৈরির খেয়াল, কিছুটা খেলা, কিছুটা হুজুগ৷

আমাদের মালদা এখন টেলিগ্রামেও। জেলার প্রতিদিনের নিউজ পড়ুন আমাদের অফিসিয়াল চ্যানেলে। সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন


বিজ্ঞাপন

Malda-Guinea-House.jpg

আরও পড়ুন

bottom of page