হৃদমাঝারে বাউল
বিগত কয়েক বছর থেকে মালদহ জেলার বিভিন্ন স্থানে বাউল উৎসবের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রথম অবস্থায় জেলার দুই এক স্থানে এই বাউল উৎসব শুরু হলেও বর্তমানে তা জেলার বিভিন্ন স্থানে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে সারাবছর ধরেই বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে চলছে বাউল গানের অনুষ্ঠান। কোথাও দুই দিন, কোথাও তিন দিন কোথাও বা আবার এক সপ্তাহ অর্থাৎ ৭ দিন ধরে চলছে বাউল সংগীতের আসর। আর এই উৎসবে শামিল ৮ থেকে ৮০ বছরের মানুষ সকলেই।
কিন্তু বর্তমানে কেন এই বাউলের জনপ্রিয়তা এই নিয়ে আজকের প্রতিবেদন। প্রায় দুই দশক আগে পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন স্থানে কোনো ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে একদিন বা দুই দিনের জন্য সেখানে বাউল গানের আসর বসত। তবে পরবর্তীকালে পুরাতন মালদা ব্লকের সাহাপুর গ্রামের অধিবাসীরা দোলপূর্ণিমা উপলক্ষ্যে প্রথম ৭ দিনের বাউল উৎসবের সূচনা করেন। প্রথমদিকে তা ছিল নিতান্ত সাদামাটা। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে উত্তরোত্তর এর বৃদ্ধি পেতে থাকে। শুধু তাই নয় এই বাউল মেলার সংগঠকরা তাদের অনুষ্ঠানে অনেক বেতার ও দূরদর্শনখ্যাত বাউল শিল্পীর আমন্ত্রণের মাধ্যমে তাদের বাউল উৎসবের কৌলীন্য বৃদ্ধি করাতে সক্ষম হয়েছেন। খাতনামা বাউল শিল্পীদের মধ্যে পূর্ণদাস বাউল, সমীরণ দাস বাউল, সনজিৎ দাস, এছাড়া বেশ কিছু আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী নিলুফার লিলি, এস বিজয় এই উৎসবে সংগীত পরিবেশন করেছেন।
প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে যে, মালদা জেলার বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে বাউল গান যথেষ্ট জনপ্রিয়। এই জনপ্রিয়তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সার্ক কালচারাল সোসাইটির নির্বাহী সভাপতি এটিএম মমতাজুল করিম বলেন যে, মালদা জেলার সীমান্তবর্তী অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষই বাংলাদেশ থেকে রাজনৈতিক কারণে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, যারা বর্তমানে ভারতের নাগরিক। এদের জীবনযাত্রা খুবই সাধারণ ও তারা ধর্মভীরু। সামাজিক পেশাগত দিক থেকে এরা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কিত বাউল, ভাটিয়ালি, সারিগানের গুণমুগ্ধ শ্রোতাও বটে। কারণ বাউল, ভাটিয়ালি ইত্যাদি গানগুলি বাংলার সাধারণ মানুষের সমাজ ও জীবনযাত্রার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এই সকল অঞ্চলে বাউল গানের জনপ্রিয়তা যথেষ্ট। তিনি আরও বলেন যে, মূলত হিন্দুদের কোনো ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলগুলিতে বাউল গান ও উৎসব চলে। কিন্তু বর্তমানে এই উৎসবে মুসলিম শিল্পিরাও জাতি-ধর্মের ভেদাভেদ না করে এই উৎসবে শামিল হয়ে সুফি গান ও লোকগীতি পরিবেশন করেন। যার মূল অর্থই মানবজীবনের গান।
উদ্যোক্তাদের বক্তব্য,
"প্রায় একই বক্তব্য জেলার বেশ কয়েকটি বাউল গানের উদ্যোক্তাদের। তাদের বক্তব্য যে, স্থানীয় শ্রমজীবি মানুষদের আনন্দদানের অন্যতম হাতিয়ার হল এই বাউল গান, কারণ এই গানের ভাষা ও অর্থ সাধারণ মানুষের মন ছুঁয়ে যায়। প্রত্যেক উদ্যোক্তাদের দাবি, প্রত্যেক বছর তাদের বাউল উৎসবে জনসমাগম ক্রমশ বেড়েই চলেছে। শুধু সাধারণ মানুষ নয় জেলার প্রতিষ্ঠিত বহু ব্যক্তিত্ব এই বাউল গানগুলির পৃষ্ঠপোষক ও শ্রোতা এবং তাঁরা আর্থিকভাবে এই বাউল উৎসবের জন্য সহায়তা করেন বলে দাবি করেছেন জেলার বিভিন্ন বাউল উৎসবের উদ্যোক্তা'রা"
এখন প্রশ্ন হল এই উৎসবের জন্য যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয় তার উৎস কী? বাউল রীতি অনুযায়ী উৎসবে আগত দর্শনাথী ও শ্রোতারা বাউলদের ভিক্ষের ঝুলিতে অর্থ ও খাদ্যসামগ্রী দান করে থাকেন এছাড়া জেলার বাইরের বহু মানুষ আর্থিক সহায়তা করে থাকেন। এর জন্য তাঁরা জেলাবাসীর সহযোগিতা প্রার্থনা করে থাকেন এবং প্রতিবছর এই উৎসব সফল করার জন্য তাঁরা সকলকে ধন্যবাদ জানান।
সর্বশেষে বলা যেতে, পারে যে বিভিন্ন বিনোদনমূলক চ্যানেলগুলিতে যে আধুনিক গানের ব্যাপক প্রচার বর্তমানে বিরাজমান তা সত্ত্বেও মালদা জেলায় বাউল গানের শ্রোতার সংখ্যা ক্রমশ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেলার বিভিন্ন লোকশিল্পী ও বাউলশিল্পীরা একযোগে স্বীকার করেন যে, বর্তমানে আধুনিক গানের যারা শ্রোতা তারাই আবার বাউল গানের শ্রোতা। বিশেষ করে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে বাউল গানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে তাঁদের দাবি। আর এই বাউল উৎসবকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হছে মানুষের মিলনমেলা।
আমাদের মালদা এখন টেলিগ্রামেও। জেলার প্রতিদিনের নিউজ পড়ুন আমাদের অফিসিয়াল চ্যানেলে। সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
Comments