সতেরো তিনে ছাপ্পান্ন
ডাকাত মানেই ভয়ংকর, আর যদি কালীপুজোর কোনো রাতে ওদের খপ্পরে পড়া যায়, তাহলে যেমন ভয়ংকর হবে তেমনই হবে রোমাঞ্চকর। ছোটো থেকে হিরু ডাকাতের গল্প শুনে বড়ো হওয়া, তবে ছোটোবেলায় ডাকাতদাদু মানে ডাকাত সর্দার জিতুর খপ্পরে পড়েছিলাম। তখন সবে ক্লাস টুয়ে পড়ি। নামতা তখনো মুখস্থ থাকতো না, বারবার সতেরো তিনে ছাপ্পান্ন বলতাম।
গ্রামের নাম ভূতনি। আমাদের গ্রামের বাড়ি, মামার বাড়িও। ছোটো থেকে তিনবছর কেটেছে গ্রামে, এখন শহরে, তবে মাঝে মাঝে যাওয়া হয়। ছোটোবেলায় মামার বাড়ি যেতাম, তখন দিদার কাছে অনেক গল্প শুনতাম। আর দিদা যেটা সব থেকে ভালো বলতো, সেটা হিরু ডাকাতের গল্প। হিরু ডাকাতকে নাকি দিদা-দাদু দু’জনেই স্বচক্ষে দেখেছে, জানি না কতটা সত্যি। তবে ডাকাত যে আছে, সেটা আমি জানি। কালীপুজোর সময় একবার আমি দিদার বাড়ি গিয়েছিলাম, তখন আমি সবে ক্লাস টুয়ে পড়ি। কালীপুজোর রাতে গ্রামেরই এক মন্দিরে আমরা সবাই গিয়েছি পুজো দিতে। তখনো ভূতনিতে ইলেকট্রিসিটি পৌঁছায়নি।
ডাকাতটা চোখগুলো লাল লাল করে আমার দিকে তাকাল। চিৎকার করে বলল, ‘তুই জিতু ডাকাতের খপ্পরে পড়েছিস। তুই সতেরোর নামতা না বলতে পারলে, তোকে নরবলি দিব’।
আলো বলতে হ্যাজাকের আলো, শুধুমাত্র মন্দিরকে আলোকিত করছে। আমি আর আমার মামাতো ভাই মিলে পটকা ফাটাচ্ছি। গ্রামের মন্দির চারিদিকে অন্ধকার মাঠ। কোথাও আলো নেই, দূরে গ্রামের বাড়িগুলোতে আলো জ্বলছে। একেই অমাবস্যা, তার মধ্যে কালীপুজোর রাত। বাড়ির সবাই মন্দিরে পুজোয় ব্যস্ত। আমি একটা চকোলেট ব্যোম ধরিয়েছি, মামাতো ভাই দে ছুট। আমি ধরিয়েই চোখ-কান বন্ধ করে ফেলেছি। একটা বড়ো দুম আওয়াজে ফেটে গেলো ব্যোমটা, চোখ খুললাম। একি সামনে তো কোনো মন্দির নেই, একটা চালের নীচে মা কালীর মূর্তি ভয়ংকর সে রূপ। সামনে কতগুলো লোক ঠিক যেমনটা দিদা গল্পে বলত। বড়ো বড়ো চেহারা, ইয়া বড়ো গোঁফ, মাথায় লাল পাগড়ি, কপালে লাল টিপ, হাতে বল্লম। ঠিক হিরু ডাকাতের মতোই কতগুলো ডাকাত। কিন্তু কিন্তু করতেই সামনে এক ডাকাত এসে, আমাকে ধরে নিয়ে গেলো মা কালীর সামনে, যে ডাকাতটা পুজো করছিলো তার সামনে। চোখগুলো লাল লাল করে আমার দিকে তাকাল। এক হুংকারে আমাকে জিজ্ঞেস করল ‘কিসে পড়িস?’ আমি তো ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলাম, ক্লাস টু। কিন্তু দিদা তো আমাকে কোনোদিন বলেনি যে, ডাকাতরা চশমা পরে। এই ডাকাত পরে ঠিক আমার দাদুর মতো, দিদার ঘরে যে ছবিটা আছে সেই ছবিটার মতোই হুবহু, তবে ছবিতে গোঁফ ছিল না। চিৎকার করে বলল, ‘তুই জিতু ডাকাতের খপ্পরে পড়েছিস। তুই সতেরোর নামতা না বলতে পারলে, তোকে নরবলি দিব’। নরবলি কী তখন না জানলেও এইটুকু বুঝেছিলাম আমি সতেরোর নামতা না বললে আমার রক্ষে নেই। দিদার কাছে শুনেছিলাম দাদু প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। এসব ভাবতে ভাবতেই আবার হুংকার ‘সতেরোর নামতা বল, তুই যে পড়াশোনা করিস না তা আমি জানি’। আমার তো তখন শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে। এ কী করে জানলো আমি পড়াশোনা করি না। আর নামতা যে আমি মুখস্থ করতে পারি না, আর শেষে এই নামতাই জিজ্ঞেস করার ছিল। এতো সব পৃথিবীতে প্রশ্ন আছে সেগুলো করতে পারতো। পৃথিবীতে কত ভাগ জল কতভাগ স্থল, গাছ শ্বাস নেওয়ার সময় কী গ্রহণ করে, আরে দশরথের বাবার নাম কী জিজ্ঞেস করলেও, পারতাম। সব ছেড়ে সতেরোর নামতা। শরীর কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতেই বললাম, সতেরো এক্কে সতেরো, সতেরো দুয়ে চৌত্রিশ, সতেরো তিনে ছাপান্ন। আবার হুংকার, ‘কী সতেরো তিনে ছাপান্ন!’ মনে হল কে যেন গালে সপাটে এক চর কষিয়ে বলল, ‘সতেরো তিনে একান্ন’। তারপর আর জ্ঞান ছিল না, যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমি দিদার ঘরে, বিছানায়। মা জিজ্ঞেস করেছিল, কী হয়েছিল আমার যে আমি সতেরো তিনে একান্ন বিড়বিড় করছিলাম। কিছু বলতে পারিনি। পরে দিদার কাছে জেনেছিলাম, দাদু অঙ্কের স্যার ছিল। দিদা এও বলেছিল, দাদু নাকি সতেরো তিনে ছাপ্পান্ন পড়াতো সবাইকে। হয়তো দাদুই এখন জিতু ডাকাতকে জানে, তবে আমি এখন সতেরো তিনে ছাপ্পান্ন বলি না একান্নই বলি।
ইলাসট্রেশনঃ মৃণাল শীল
Kommentare