রস কথা
চারপাশের মস্তিবাচক স্রোতের পাশাপাশি আমাদের পড়শি হয়ে বয়ে চলেছে এক সমান্তরাল ভারতবর্ষ যেখানে ‘কেঁচো’দের বাস৷রোজকার ধূলি-রোদে আর অবহেলায় গড়াগড়ি খায় এদের জীবন৷ সেদিকে তাকিয়ে আমরা তাক করে উদাসীন৷খুব বেশি হলে এদের নিয়ে আমাদের ভাবনা ফেসবুকে আটকে থাকে৷কিন্তু ফেসবুকের লাইক-কমেন্টের সীমা ছাড়িয়ে আরও বড়ো এক উঠোনে অর্থাৎ সিনেমায় এদের কথা বলেন এক এনজিও দাদা৷ এই এনজিও দাদার নাম পাভেল৷এই অন্যায় সর্বস্ব পৃথিবীটার সঙ্গে দর কষাকষি করে যাদের জীবন চালিয়ে যেতে হয়, সেই ডাস্টবিনের পুতুলদের জীবন্ত করে তোলেন পাভেল তাঁর ছবিতে৷পাভেল তাঁর নামের সঙ্গে পদবি ব্যবহার করেন না৷কারণ পাভেল মনে করেন পদবি একটা মানুষের জাতি ধর্মের পরিচায়ক, মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে৷
প্রশ্নঃ আপনি একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদক, একজন ইলাস্ট্রেটর আবার একটি এনজিও-র সাথেও যুক্ত আছেন৷ সিনেমায় এলেন কেন? আমি যেমনভাবে একজন ইলাস্ট্রেটর, যেমনভাবে এনজিও করি, যেমনভাবে একটা ম্যাগাজিন সম্পাদনা করি, তেমনভাবেই আমি ফিল্মের সঙ্গে জড়িত৷ আলাদা করে আমাকে আসতে হয়নি৷ প্রায় পনেরো বছর বয়েসে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, আমি ফিল্ম ডিরেক্টর হতে চাই৷ ম্যাগাজিন করা, ইলাস্ট্রেসন করা- এ’সব কিছুই সিনেমার অংশ৷ ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রটা আমার রাজনৈতিক চেতনার একটা বড়ো জায়গা, সেটা এনজিও-র ক্ষেত্রেও, সেটা আমার সিনেমার ক্ষেত্রেও৷
প্রশ্নঃ ‘বাবার নাম গান্ধিজি’ হোক কিংবা ‘চেগু’-আপনি কি সচেতনভাবে আপনার ছবিতে প্রান্তিক মানুষদের কথা বলতে চেয়েছেন ? এই কনজিউমারিজমের বাজারে এটা আমার সচেতন প্রচেষ্টা তো বটেই৷ আমার বড়ো হয়ে ওঠা প্রান্তিক মানুষদের সাথে৷ যা জীবনে দেখছি,যা ঘটছে সেখানে দাঁড়িয়ে একটা স্ট্যান্ডপয়েন্ট নিতে হয় পরিচালককে৷ আমি যাদের পক্ষে তাদের হয়েই স্ট্যান্ডপয়েন্ট নিয়েছি৷ প্রসঙ্গত, ‘চেগু’ আমি প্রডিউস করছি এবং স্ক্রিপ্ঢটা লিখেছি কিন্তু ‘চেগু’র ডিরেক্টর নবমিতা৷
প্রশ্নঃ ‘বাবার নাম গান্ধীজী’ তে মহাত্মা গান্ধি আবার ‘চেগু’তে চে গুয়েভারা- আবার কোথাও নবারুণ ভট্টাচার্য - এই মৃত্যু উপত্যকায় এদের প্রাসঙ্গিকতা কতটা বলে আপনি মনে করেন? এদের প্রাসঙ্গিকতা কতটা সেটা বলার স্পর্ধা বা ঔদ্ধত্য কোনোটাই আমার নেই৷ আমি যেটা বলতে পারি, এই তিনজন মানুষই আমাকে প্রচণ্ড ভাবিয়েছেন৷ মহাত্মা গান্ধি এবং চে গুয়েভারার বিশ্বাস এবং রাজনীতি আমাকে ভাবিয়েছে৷ যদিও দুজনের রাজনীতি যথেষ্ট বিপরীতধর্মী কিন্তু কোথাও গিয়ে দু’জনের গন্তব্য মিলছে৷ আর, নবারুণ স্যারের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল, ওনার প্রভাবটা অনেক বেশি আমার উপর এই দু’জনের থেকে৷ আমার কাছে উনি অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক বাকি দু’জনের থেকে৷ কারণ এরকম একটা সময়ে দাঁড়িয়ে একটা মানুষ হিপোক্রেসি পুরোপুরি বর্জন করে কি করে নিজের জায়গায় অটল থেকে কাজ করতে পারেন, সেটা আমি ওনাকে দেখেই শিখেছি৷
প্রশ্নঃ মশালাদার বাংলা ছবি বাদ দিয়ে বাংলায় আর যে ছবিগুলো হচ্ছে সেগুলো ভীষণভাবেই এলিট, তার অধিকাংশ হয় সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে নয়তো গোয়েন্দা গল্প৷ দীর্ঘদিন থেকেই বাংলা ছবিতে দুঃখজনকভাবে বৈচিত্র্য অনুপস্থিত৷ আপনার মতামত? বৈচিত্র্য অনুপস্থিত বলেই আমি ছবি করছি, বৈচিত্র্য আনছি৷ ‘বাবার নাম গান্ধিজি’ করেছি তারপর ‘চেগু’ প্রডিউস করেছি, এখন ‘রসগোল্লা’ করছি৷ সামনে আরও নতুন কিছু করব৷ এছাড়াও বিভিন্নভাবে বিভিন্ন লোক চেষ্টা করছে৷ যদিও আপনার মতামতের একটা বড়ো জায়গা থাকেই যে, দর্শকদের মধ্যে গোয়েন্দা প্রীতি বেশি৷ বক্স-অফিসও বলছে যে, দর্শক গোয়েন্দা গল্পই দেখতে চায় বারবার৷ সে কারণে সবাই একটা সেফ গেম খেলে গোয়েন্দা ছবি করছে৷ এগুলো নির্ভর করে মার্কেটের ডিম্যান্ডের উপর৷ তার মধ্যেও আমাদের মত মানুষ চেষ্টা চরিত্র করে যায়, এখনো করে যাচ্ছি৷
প্রশ্নঃ বাংলা ছবিতে সেভাবে দলিতদের কথা উঠে আসেনি৷ উঠে আসেনি মুসলিম সমাজের কথাও৷ মুসলিমরা আজও বাংলা ছবিতে মুখে দাড়ি আর মাথায় ফেজ পরে স্টিরিওটাইপড হয়ে থেকে গেছে৷ জুলফিকারের স্মৃতি এখনো টাটকা৷ একজন শিল্পী হিসেবে কীভাবে দেখছেন ? আমি ‘চেগু’র যে স্ক্রিপ্ট লিখেছি সেটা পুরোপুরি একটা মুসলমান পরিবারের গল্প৷ চেগুর ভালো নাম হচ্ছে মানসুর এবং সে এই ছবির প্রধান চরিত্র৷ বিনয় পাঠক যে চরিত্রে অভিনয় করছেন তার নাম আজমাল৷ কলকাতার মুসলমান বস্তির চিত্র এই ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে৷
প্রশ্নঃ রাজ্যের সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ মাল্টিপ্লেক্স দর্শক পাচ্ছে না৷ বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ কীরকম দেখছেন? পশ্চিমবঙ্গের মানুষ চেয়েছে যে এখানে কেউ চাকরিবাকরি করবে না, সবাই বাইরে চলে যাবে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ চেয়েছে যে তারা প্রোমোটারি যুগ, রাহাজানি যুগে থাকবে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ চেয়েছে যে তারা অপশাসনের মধ্যে থাকবে,পশ্চিমবঙ্গের মানুষ চেয়েছে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্র্যাজুয়েট হবার কোনো দাম থাকবে না, শিক্ষার মান বলে কিছু থাকবে না, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ চেয়েছে এই সাংসৃকতিক অবনমন, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ চেয়েছে যে দক্ষিণি ছবি থেকে কপি করে করে আমরা ছবি বানাব আর সেটা দেখে আনন্দ পাবে, তো পশ্চিমবঙ্গের মানুষ দায়িত্ব নিয়ে চেয়েছে সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাক, তাই হচ্ছে৷ এটা এই এক লাইনের গল্প না, এটা বিশাল এক রাজনীতির পাঠ৷
প্রশ্নঃ আপনার পরবর্তী ছবি ‘রসগোল্লা’ একটি পিরিয়ড ছবি-নবীনচন্দ্র দাস নামক একজন সাধারণ নিম্নবর্গীয় মানুষের উত্থানের কাহিনী৷ এর আগে পিরিয়ড ছবি বলতে আমরা রাজা-রাজডার কাহিনী দেখে এসেছি৷ আপনি কিছু বলুন৷ হ্যাঁ, রসগোল্লা আমার খুব প্রিয় ছবি৷ প্রায় আড়াই বছর ধরে শুধু রসগোল্লা বানাব বলে অন্য কোনো কাজে ফোকাস করিনি৷ এটা ১৮৬০ সালের গল্প নিয়ে একটা পিরিয়ড ছবি৷ নবীনচন্দ্র দাস, যিনি রসগোল্লা আবিষ্কার করেছিলেন তাঁর বায়োপিক এবং তার পেছনে একটা মিষ্টি সুন্দর প্রেমের গল্প৷ রসগোল্লা বড়ো বাজেটের ছবি, সব মিলে প্রায় পৌনে তিন কোটির কাছাকাছি৷ তো এরকম বড়ো বাজেটের ছবি মানেই, সেখানে স্টার লাগে মানে জিত দা, বুম্বাদা আর ছবিটা তখন আর্টিস্ট প্রধান ছবি হয়ে যায়৷ কিন্তু রসগোল্লার মতো বড়ো বাজেটের ছবিতে কনটেন্টকে গুরুত্ব দিয়ে আমি ডিরেক্টর প্রধান ছবি করতে চেয়েছিলাম এবং নতুনদের নিয়ে এই ছবিতে কাজ করছি৷ এরকম বাজি কেউ লড়েনি৷ উইনডোজ-রা রাজি হয়ে যায় ছবি প্রডিউস করতে রসগোল্লা বিষয়টার জন্য৷ যদি এই ছবিটা তার জায়গা থেকে বক্স অফিসে সাফল্য পায়, তাহলে এটা পাথেয় হয়ে দাঁড়াবে আগামীদিনের নতুন বা অনেক পরিচালকের জন্য যে স্টার পাওয়ার ছাড়াও বড়ো ক্যানভাসে ছবি করা যায়৷ এবার বাকিটা দর্শকদের হাতে৷
আমাদের মালদা এখন টেলিগ্রামেও। জেলার প্রতিদিনের নিউজ পড়ুন আমাদের অফিসিয়াল চ্যানেলে। সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
Comentários