গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, এক ভূতুড়ে যাত্রার সালতামামি
যাত্রা শুরু হয়েছিল ঠিক ১০ বছর আগে৷তারপর থেকে যাত্রা চলছেই৷একটা যাত্রাপালা শেষ হতে না হতেই নতুন যাত্রাপালার শুরু৷উচ্চগ্রামের নাটকীয়তায় ভরপুর কিশোর গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রাপথ৷১০ বছরে মোট পাঁচজন উপাচার্য, জনা পাঁচেক নিবন্ধক (স্থায়ী কেউই নন), বেশ কয়েকজন ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ামক (মাত্র একজন স্থায়ী তাও মাত্র কয়েক মাসের জন্য) - সব মিলিয়ে দু’হাতের কর গুনে শেষ করা যাবে না৷ভারপ্রাপ্তদের ভার নিতে নিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাঁড়ারে এখন অগুন্তি প্রাক্তন এবং বর্তমান ভারপ্রাপ্তদের ভিড়৷সব মিলিয়ে গৌড়বঙ্গের তিন জেলার নাগরিকদের কাছে এই বিশ্ববিদ্যালয় মানেই নিত্যনতুন গৌরচন্দ্রিকা৷এককথায় এক ভূতুড়ে দশায় তিন জেলার শিক্ষাক্ষেত্রের সবচেয়ে উঁচু এই প্রতিষ্ঠান৷
তার মধ্যেই দু’ দু’বার এই বিশ্ববিদ্যালয়েই বসে গেছে জাতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের অধিবেশন৷জাতীয়স্তরে যতটা না খ্যাতি এসেছে, অধিবেশন শেষ হতে না হতেই বিপুল আর্থিক অস্বচ্ছতা’র অভিযোগে গ্লানি ম্লান করে দিয়েছে সেই প্রশংসা৷একের পর এক অস্বচ্ছতা, অনিয়ম, বেনিয়ম, অনৈতিকতা, তুঘলকি প্রশাসনিক কার্যকলাপ রোজনামচা হয়ে উঠেছে গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে৷
অনেকেই সদিচ্ছা নিয়ে নিজের নিজের মতো করে চেষ্টা করেছেন হাল ধরতে৷ কিন্তু ‘কান্ডারি হুঁশিয়ার’ বলে তাঁদের বারংবার থমকে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ জটিলতা৷
হতাশা তৈরি হয়েছে সব মহলেই৷নিত্যদিন সংবাদমাধ্যমে গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের একের পর এক নেতিবাচক সংবাদ আর ছবি দেখে হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন শুভাকাঙ্ক্ষীরাও৷
অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না৷কিন্তু হয়েছে৷কেন হয়েছে তার উত্তর কোনো নির্দিষ্ট পাটিগণিত মেনে পাওয়া অসম্ভব৷তবু বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েকবার উৎসুক পদচারণা করলেই বেরিয়ে আসবে বেশ কয়েকটি ভূতের কাণ্ড৷ যেমনঃ
নিয়োগ ভূত
স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিজেদের ক্ষমতার স্বর্ণযুগে লাগামছাড়া নিয়োগ করেছেন অযোগ্য অনুগামীদের৷ সব জেনেও ধৃতরাষ্ট্রের ভূমিকা পালন করেছেন কর্তৃপক্ষ৷
লড়াই ভূত
বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে তৈরি হয়েছে অধ্যাপক এবং আধিকারিকদের একাংশের ভুঁইয়াবাহিনী৷ বারো ভুঁইয়ার ধাঁচেই তাঁরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের মধ্যে৷
ক্ষমতা ভূত
লড়াইয়ের একমাত্র লক্ষ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলি দখল করা বা নিজেদের পছন্দের লোকদের পদগুলিতে বসানো৷ তাতে করে ক্রমশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে ফেলা যায় ক্ষমতার জাল৷
খরচ ভূত
লাগামহীন এবং বেহিসাবি খরচ৷ ক্ষমতায় আসীন থাকার সুযোগ নিয়ে ঘনিষ্ঠ মহলকে পাইয়ে দেওয়া বিভিন্ন বরাত৷ অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা দেখে গুলিয়ে যেতে পারে এটি আসলে ‘বিশ্ববিদ্যা তীর্থ-প্রাঙ্গণ’ নাকি জাতীয় সড়কের ধারে তৈরি হওয়া ঝাঁ চকচকে তারকাখচিত হোটেল!
শূন্য ভূত
ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করতে শূন্য রাখা হয়েছে নিবন্ধক, পরীক্ষা নিয়ামকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলি৷ উপাচার্যরা গেছেন, এসেছেন৷ অদ্ভুতভাবে শূন্য থেকে গেছে ওই দুটি পদ৷ অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে পেয়েছেন বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ৷
পরীক্ষা ভূত
পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা৷ পরপর অভিযোগ উঠেছে কোনো এক পরীক্ষা ভূতের দৌলতে, ভোজবাজির মতো পরিবর্তিত হয়েছে প্রাপ্ত নম্বর৷
মারকুটে ভূত
বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই বেশ কয়েকবার পেশীশক্তির নির্লজ্জ আস্ফালন দেখে স্তম্ভিত হয়েছেন অনেকেই৷ বিবদমান ছাত্রছাত্রীদের রাজনৈতিক গোষ্ঠী সংঘর্ষ ছাড়াও নিগৃহীত হয়েছেন অধ্যাপক থেকে আধিকারিকরাও৷
বারবার এমন হাজার ভূতের বেয়াদপিতে থমকে গেছে সাবালকত্বের পথে পা বাড়াতে চলা এই কিশোর বিশ্ববিদ্যালয়ের গতি৷ সুখের কথা, এরই মধ্যে ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল-এর অনুমোদন মিলেছে৷ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে ২ (এফ) এবং ১২ (বি) অনুমোদনও পাওয়া গেছে৷
তারপরেও বারেবারেই ‘বাঁশি সংগীতহারা’ হয়েছে গৌড়বঙ্গের প্রিয় এই বিশ্ববিদ্যালয়৷ একের পর এক যাত্রা দেখতে গিয়ে অবিন্যস্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রাপথ৷
এত কিছুর পরেও তিন জেলার আপামর নাগরিকের শুভেচ্ছা রয়েছে গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে৷ প্রত্যাশা, এই শুভেচ্ছাকে পাথেয় করে নিজেদের নাক কেটে নিজেদেরই যাত্রা ভঙ্গ না করে সদর্থক এবং স্বচ্ছ শিক্ষার যাত্রাপথে এক উন্নততর মাত্রা যোগ করার সদিচ্ছা দেখা যাবে এই নবীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩ একরের ক্যাম্পাসে৷
আমাদের মালদা এখন টেলিগ্রামেও। জেলার প্রতিদিনের নিউজ পড়ুন আমাদের অফিসিয়াল চ্যানেলে। সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
ছবিঃ অসীম ভগত
Comments