সৌম্য দে সরকার

May 29, 2017

মাদ্রাসার মাসুমা রোদ্দুর হতে পেরেছে

Updated: Feb 24, 2023

মাধ্যমিকের রেজাল্ট মানেই হইচই। কৃতিদের ফলাও ছবি। বিস্তারিত বিবরণ। কি খেয়েছিলো, ক’টা টিউশন ইত্যাদি। মায় তাদের বাবা-মা’য়েরও। সাফল্যের ফ্ল্যাশগানে দশের মধ্যে এক হওয়া সন্তানকে রসগোল্লা খাওয়ানোর তৃপ্ত মুহূর্ত। কিন্তু হাই মাদ্রাসা’র কৃতিরা? একই সাফল্যের পরেও কোথাও যেন দুয়োরানীর সন্তান। নেহাৎ না দিলেই নয়। তাই মেপে মেপে নিউজপ্রিন্ট খরচ। টিভি চ্যানেলের উদাসীনতা আরও প্রকট। ভিস্যুয়াল ছাড়াই কখনো দু’লাইন বলে দেওয়া। কখনো বা তাও নয়। জাস্ট একটা দায়সারা স্ক্রিন-স্ক্রল। তবুও মাসুমা খাতুনরা লড়াইটা চালায়। প্রতিবারই। বিড়ি বাঁধতে বাঁধতে শুধু টেক্সট বইয়ের পাতা উল্টে প্রস্ততি চালিয়ে যায় এক অসম লড়াইয়ের। বেশিরভাগ পরিবারে নৈর্ব্যক্তিক উদাসীনতা। সম্বল বলতে কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছে ক্লাসে এবং ক্লাসের বাইরে পড়াটা দেখিয়ে নেওয়া। আর ‘ভাগ্যিস’ আজাদ মাস্টারের মতো ঘরের খেয়ে পড়াশোনার মোষ তাড়িয়ে শেষ দেখতে চাওয়া কিছু নাছোরবন্দা মানুষ।

মাসুমা খাতুন এ বছরের হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় রাজ্য মেধা তালিকায় শুধু তৃতীয় নয়, মেয়েদের মধ্যে রাজ্যে একেবারে প্রথম।

কালিয়াচকের বামনগ্রাম-মোসিনপুরের মাসুমা খাতুন এ বছরের হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় রাজ্য মেধা তালিকায় শুধু তৃতীয় নয়, মেয়েদের মধ্যে রাজ্যে একেবারে প্রথম। শিশু মাসুমা মা-বাবার হাতে রসগোল্লা খেয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে পারেনি। থাকার বলতে শুধু ঠাকুরদা মোরশেদ সেখ আর ঠাকুমা। বৃদ্ধ দম্পতিকে কোলে-পিঠে বড়ো করা নাতনি’র চোখ-ধাঁধানো সাফল্যের খবরটা পৌঁছে দিয়েছিল মডেল শিশু শিক্ষা নিকেতনের সেই আজাদ মাস্টার। দারিদ্র্যের ভারে ন্যুব্জ, ক্লান্ত মোরশেদ সেখ ক্লাস ফোর অবধি পড়া মাসুমাকে বাড়িতে রেখে দেবে ভেবেছিল নিতান্ত বাধ্য হয়ে। বিড়ি বাঁধতে বাঁধতে একটু একটু করে বড়ো হয়ে ওঠা মাসুমা একদিন চলে যেত পরের ঘরে। অমলকান্তির মতোই রোদ্দুর হওয়া হতো না মালদায় সুজাপুরের মাসুমারও। কিন্তু মাসুমার তো আজাদ মাস্টার ছিল। আর ছিল আজাদ মাস্টারের সঙ্গে মডেল শিশু শিক্ষা নিকেতনে পড়ানো আরও কয়েকজন ‘জহর চেনা জহুরি’ শিক্ষক। মোরশেদসাহেবকে বুঝিয়ে ওঁরাই মাসুমা’কে পাঠালেন বটতলা আদর্শ হাই মাদ্রাসায়। শিক্ষার লড়াইয়ে রোল-মডেল হয়ে ওঠার আদর্শ পরিবেশ পেল মাসুমা। পেল মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়মিত গাইডেন্স। প্রধান শিক্ষক মহম্মদ সাদ’ও বুঝেছিলেন একটু একটু করে তৈরি হচ্ছে সাফল্যের একটি ইতিহাস।

আজাদ মাস্টাররা কিন্তু হাত ধুয়ে ফেলেননি। নিয়মিত ছুটে গেছেন মাসুমার কাছে। পালা করে। প্রতি মাসে। সীমিত সামর্থ নিয়ে পাশে থেকেছেন। কখনো হাতে তুলে দিয়েছেন গোটা কয়েক ফল। আর মাসুমা এগিয়েছে। এগোতে ২০১৭’র ১৬ মে। রাজ্যে সেরাদের অন্যতম সেরা মাসুমা। এখন উত্তর দিনাজপুরের জিডি মিশনে বিজ্ঞান নিয়ে একাদশের ছাত্রী মাসুমা। ছবি পাওয়াটাও দুষ্কর ছিল আজাদ মাস্টারই যোগাড় করে দিয়েছেন সংবাদমাধ্যমের জন্য। জানিয়েছেন, মাসুমাকে স্নেহ করেন নিজের বোনের মতোই। তিনি নিজে এবং অন্যান্য শিক্ষকরা। ঠাকুরদা মোরশেদ শেখের অবস্থা জেনে ওই শিক্ষকরাই মিষ্টি বিলি করেছেন গ্রামে। কে বলে মাসুমা একা ! তার সাফল্যে এলাকায় তখন গণ- উৎসব। নাই বা থাকলো ফ্ল্যাশের ঝলকানি। জেলার মাদ্রাসার এই একরত্তি মেয়ের দাঁতে দাঁত চাপা লড়াইয়ে এবং সাফল্যে গর্বিত হোক ‘আমাদের মালদা’। অমলকান্তি পারেনি। মাসুমা পেরেছে। কষ্ট মুছিয়ে দেওয়া তৃপ্তির রোদ্দুর মাসুমা মাখিয়ে দিয়েছে পুরো মালদাকেই।

আমাদের মালদা এখন টেলিগ্রামেও। জেলার প্রতিদিনের নিউজ পড়ুন আমাদের অফিসিয়াল চ্যানেলে। সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন