কতটা রাঙা হলে স্বপ্ন পূরণ হয়
top of page

কতটা রাঙা হলে স্বপ্ন পূরণ হয়

২০১৬ তে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘পিঙ্ক’ এর হাত ধরে এই ২০১৭ তেও বেশ কিছু নারীকেন্দ্রিক ছবি মুক্তি পেয়েছে-- ফিল্লৌরি, আনারকালি অফ আরাহ, সোনাটা, বেগম জান, নূর, মম ইত্যাদি৷ এই তালিকায় নবতম সংযোজন অলংকৃতা শ্রীবাস্তবের ‘লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা’৷ পহেলাজ নিহালনির (পড়ুন সংস্কারি পুরুষের) রক্তচক্ষুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গত মাসের একুশ তারিখে সারা দেশে মুক্তি পেয়েছে এই ছবি৷

পরিচালক প্রশ্ন তুলেছেন নারীদের ক্ষেত্রে যৌন উদ্দীপনা ঠিক কোন বয়সের ধর্ম? এটা শরীর বলে দেবে নাকি সমাজ (পুরুষ)?

ভোপালের ‘হাওয়াই মঞ্জিল’ চার ভিন্ন বয়সের এবং ভিন্নরুচির নারীদের এক ছাদের তলায় এনেছে৷ ছবিতে বোরখা হল মেটাফর৷ নিপীড়নের প্রতীক৷ বোরখার ভেতরে এবং বাইরে চার নারীর দ্বৈত জীবন৷ পঞ্চান্ন বছর বয়সি ‘বুয়াজি’(রত্না পাঠক) ছোটোবড়ো সকলের বুয়াজি৷ এই বুয়াজি ‘লেবেল’-এ থাকতে থাকতে বুয়াজি ভুলেই গেছে তার আসল নাম- উষা৷ আমাদের মনে পড়ে যায় সইদ মুজতুবা আলির লেখা চরিত্র ‘পঁয়তাল্লিশ নম্বর কয়েদি’র কথা৷ ছাপান্ন বছর বয়সি বিপত্নীক ভাইয়াজি আবার বিয়ে করার জন্য পঁয়ত্রিশ বছর বয়সি মেয়ে খুঁজতে পারেন কিন্তু পঞ্চান্ন বছরের বুয়াজির শরীরী চাহিদা থাকতে পারে এ যেন বিষম লোকলজ্জা৷ কিন্তু জীবনের হেমন্তে পৌঁছে বুয়াজি তার উপর চাপিয়ে দেওয়া ‘বয়সের ধর্ম’কে উপেক্ষা করে রোজ রাতে তার অবহেলিত উদ্দীপনায় সাড়া দেন-স্নানঘরে৷ হলুদ মলাটের বই-এর রাজপুত্রকে কল্পনার তুলিতে আঁকেন৷ পরিচালক প্রশ্ন তুলেছেন নারীদের ক্ষেত্রে যৌন উদ্দীপনা ঠিক কোন বয়সের ধর্ম? এটা শরীর বলে দেবে নাকি সমাজ (পুরুষ)?

কতটা রাঙা হলে স্বপ্ন পূরণ হয়

তিন সন্তানের জননী শিরীনের (কঙ্কনা সেনশর্মা) নিজের মন এবং শরীরের উপর কোনো অধিকার নেই৷ তার সৌদি ফেরত স্বামী যখন ইচ্ছে তার সঙ্গে সহবাস করে, তার কাছে শিরীন শুধুই ‘বস্তু’৷ এহেন শিরীন গোপনে তার ইচ্ছের ডানা মেলে৷ স্বামীকে না জানিয়ে সেলসওম্যান-এর কাজ করে, হতে চায় সেলস এগ্‌জিকিউটিভ৷ লীলার (অহনা কুমরা) বিয়ে ঠিক হয়েছে কিন্তু সে স্বাধীনভাবে ভেসে যেতে চায় তার প্রেমিক আরশাদ এর সঙ্গে৷ এমনকি তার এনগেজমেন্ট-এর দিন রাতে আরশাদের সঙ্গে শরীরী মিলনেও লীলা কুণ্ঠাহীন৷ বোরখার ভেতরে অর্থাৎ বাড়িতে বাবা-মার একান্ত অনুগত রেহানা (প্লাবিতা বরঠাকুর) সেলাই মেশিনে বোরখা বানায় এবং কিন্তু বোরখার বাইরে তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে লিপস্টিক৷ রাত পার্টি আর মাইলি সাইরাস, মদ, সিগারেট তার বেসুরো জীবনে সুর নিয়ে আসে৷ হাওয়াই মঞ্জিল-এর এই চার নারী বোরখার আড়ালে তাদের পরিচয়কে খুঁজতে চেয়েছে৷

ছবির পরতে পরতে দেখানো হয়েছে কীভাবে পিতৃতন্ত্রের রক্তচক্ষু, সংস্কারের নাগবেষ্টনী এবং অর্থনৈতিক দুর্বলতা এই চার নারীকে অবদমন করতে চেয়েছে৷কিন্তু তারপরেও এরা চেষ্টা করেছে নিশ্বাস নিতে নিজেদের মতো করে, গোপনে৷নারীশরীর নিয়ে যে সামাজিক ‘ট্যাঁবু’ সেটাকে অনেকটা ভেঙে ফেলেছেন পরিচালক এবং খুব অনায়াস দক্ষতায়, কোনোরকম জাঁকজমক ছাড়া৷শরীর নিয়ে ফিশফিশানিকে কয়েক ডেসিবল বাড়িয়ে দিয়েছেন৷

অহনা এবং প্লাবিতা তাদের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় করেছেন৷ শিরীনের অসহায়তা দর্শকদের ছুঁয়ে গেছে কঙ্কনার অভিনয় দক্ষতায়৷ শিরীন আমাদের মনে করাবে তাদের কথা যারা নিজের বাড়িতে ‘সেকেন্ড সেক্স’ এর মর্যাদাও পায় না, শুধু ‘বস্তু’৷ রত্না পাঠকের বুয়াজি, এরপরে কোনো বয়স্কা নারীকে নতুন দৃষ্টিতে দেখতে সাহায্য করবে৷ অথচ অভিনয়ে একটু এদিক ওদিক হলেই বুয়াজি চরিত্রটি ‘কমিক’ চরিত্র হয়ে যেতে পারত৷ মেয়েদের এই যে ক্লসট্রফবিক পরিসর যেখানে তাদের অস্ফুট রাগ, অপমান হতাশারই ভালো করে জায়গা হয় না তাকেই সুন্দর করে ‘ক্লোজ শট’ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন সিনেমাটোগ্রাফার অক্ষয় সিং৷ তার সঙ্গে ‘হাওয়াই মঞ্জিলে’র ছোটো ছোটো প্রায় অন্ধকার ঘরগুলোকে প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছে অমিত ওয়াঘচাঊরে আর বিনয় কুমারের কুশলী শিল্পনির্দেশনা৷

ভারতীয় সমাজের প্রেক্ষাপটে এই ছবি সাহসী কিন্তু নারীস্বাধীনতাকে আদৌ কোনো নতুন পথ দেখালো কি এই ছবি? চার চরিত্রই পুরুষতন্ত্রের শেকলে বাঁধা থেকেই নিজেদের মতো বাঁচবার চেষ্টা করেছে বটে, কিন্তু কেউ শেকল ভাঙার সাহস দেখালো না! বোরখার বাইরে এসেও জেহাদ ঘোষণা করল না একজনও! এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কোনো একজনেরও রাগ, দুঃখ বা হতাশার বহিঃপ্রকাশ ঘটল না! ছবির একটি দৃশ্যে লীলা মেনে নেয়, ‘আমাদের এই পরিণতি কারণ আমরা বড্ড বেশি স্বপ্ন দেখি!’ এই হেরে যাওয়ার দৃশ্য বড়ো হতাশার৷ স্বপ্ন দেখা ও স্বপ্নপূরণের মাঝের এই ব্যবধান কাটিয়ে ওঠার কোনো রাস্তা কি পরিচালক বাতলে দিলেন?

হ্যাঁ পরিচালক দেখিয়েছেন যে, মেয়েরা যৌনতায় আগ্রহী, ধূমপান করছে, মদ্যপান করছে৷ কিন্তু ধূমপান, মদ্যপান এবং যৌনতা-এইই কি নারীমুক্তির প্রতীক? এই পুরোনো ‘ক্লিশে’র বাইরে এই ২০১৭ তে পরিচালক আরও কি বিকল্প পথ দেখাতে পারতেন না? কনজিউমারিসমের আলোকে স্বাধীনতার আলো না দেখিয়ে অন্য কোনো আলোর দিশা দিতে পারতেন৷ গতবছর ২০১৬ তে পিঙ্ক-এ আমরা একটা লড়াই দেখেছি৷ এই বছর মার্চ মাসে আমরা ‘আনারকালি অফ আরাহ’ তে আনারকালিকে পেয়েছি৷ নাচনেওয়ালি আনারকালিকে কেউ এক চড় মারলে সে ঘুরিয়ে চড় মারতে দ্বিধা করেনি৷ আনারকালিরা যে সহজলভ্য নয় এটা বোঝাতে সে লড়ে গেছে৷ লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখাতে এই ‘ভয়েস’ টা নেই৷ এখানে একটি বিশেষ ব্যাপার লক্ষণীয়- কেন শিরীন বা রেহানা বা উষারা আনারকালির মতো ইটের জবাব পাথরে দিতে পারে না? নারীবাদী সমাজবিজ্ঞানী কমলা ভাসিন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সমাজে সব থেকে অবদমিত নারীরা হলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির৷ তারা লোকলজ্জা, সংস্কার আর সংসারের ভারে সব কিছু মেনে নিতে রাজি! কিন্তু অলংকৃতা শ্রীবাস্তব এই ছবিতে একটা ‘ভিজিবল’ জিহাদ এর কথা বলতে পারতেন৷ ছবির এক জায়গায় শিরীন তার স্বামীর সঙ্গে অন্য এক নারীর সম্পর্কের কথা জানতে পারে৷ শিরীন তাকে খুঁজে বের করে এবং বুঝিয়ে দিয়ে আসে যে, সে ‘শিরীন আসলাম, ওয়াইফ অফ রাহিম আসলাম’৷ অথচ স্বামীর বিরুদ্ধে তার কোনো জেহাদ দেখা গেল না৷ এটা তো পুরুষতন্ত্রের পালে হাওয়া দেওয়া হল৷

মেয়েদের বিবাহ-মাতৃত্বে বেঁধে রেখেছিল যে বলিউড এই নতুন শতাব্দীতেই মাঝেমাঝেই অন্য স্বর শোনা গেছে৷ হাইওয়ে এবং ডিয়ার জিন্দেগি দু’টি ছবিতেই ভীষণ স্বাধীনচেতা আলিয়া, সমস্ত প্রতিকূলতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে৷ এবছরের বদরিনাথ কী দুলহনিয়াতে বৈদেহীকে দেখে মেয়েদের পেশাকে সম্মান করতে শেখে বদরিনাথ৷ আজকের নারীর জন্যে পুরুষও নতুনভাবে প্রস্তুত, পালটাচ্ছে মূল্যবোধ৷ গত বছরের ‘পার্চড’ এ দেখেছি রানি বা লাজ্জ্যকে লড়াই করতে৷ তারা ভিকটিম হতে ‘রিফিউজ’ করেছে৷ এই সময়ে দাঁড়িয়ে পরিচালক অলংকৃতা আরও একটু বিদ্রোহী হতেই পারতেন৷ এত কাল ভারতীয় নারীপুরুষের মধ্যে যে হায়ারার্কি, সেটা ভাঙতে ‘ভয়েস’ টা আরও একটু জোরালো করা যেত৷ এই ফেমিনিন এজেন্সিটার দরকার ছিল বইকি৷

‘লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখার’ জন্য পরিচালক অলংকৃতার প্রশংসা প্রাপ্য৷ ছবিটি সাহসী শুধু এই জন্য নয় যে ছবিটা নারীর যৌনতা নিয়ে বলছে, তার সঙ্গে নারীর ইচ্ছে,অধিকার আর ফ্যান্টাসির দিকেও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে৷ উত্তরণের পথনির্দেশ নেই ঠিকই কিন্তু আমাদের সত্যিকারের উপস্থাপনা তো আছে৷ আমাদের (নারী-পুরুষ উভয়ের) করুণ অবস্থাটা আমরা সেলুলয়েডে দেখতে পাচ্ছি৷ উত্তরণ রাতারাতি হয় না, এখান থেকেই উত্তরণের কথা বেরিয়ে আসবে৷ বলিউড সেভাবে কখনও প্রান্তিকদের কথা, মহিলাদের কথা বলেনি৷ সেলুলয়েডে তাদের বিশ্বাসযোগ্য উপস্থাপনা দেখা যায় না৷ এই ছবিগুলো সেই কাজ করছে৷ তারা মহিলাদের কথা বলছে, মুসলিম মহিলাদের কথা বলছে৷ এই প্রচেষ্টাকে কুর্নিশ৷

পুনশ্চ: হাস্যকরভাবে ছবিটিকে বাতিল করতে গিয়ে সেন্সর বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশন বলেছিল ‘ছবিটি নারীকেন্দ্রিক, তাদের ফ্যান্টাসি জীবনকে ছাপিয়ে গেছে৷ ছবিটিতে অসংখ্য যৌন দৃশ্য, অশালীন সংলাপ, অডিও পর্নোগ্রাফি রয়েছে৷’ অথচ ‘গ্রেট গ্র্যান্ড মস্তি’ অথবা ‘মস্তিজাদে’র মত ছবিগুলো এদের নাকের ডগা দিয়ে বেরিয়ে যায়৷ সংস্কারি পুরুষের, মহিলা ফ্যান্টাসিতে প্রবল আপত্তি কিন্তু পুরুষেরা চরম কুরুচিকর বেলেল্লাপনা নিয়ে কোন অসুবিধে নেই!


আমাদের মালদা এখন টেলিগ্রামেও। জেলার প্রতিদিনের নিউজ পড়ুন আমাদের অফিসিয়াল চ্যানেলে। সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

বিজ্ঞাপন

Malda-Guinea-House.jpg

আরও পড়ুন

bottom of page