হোক চিৎকার
বিদায়লগ্নে বছরের বিষণ্ণ বর্ষফল-- স্কুলের সমগ্রতার বিপরীতে একক ছাত্রছাত্রীর গুরুত্ব শুধু রোল নম্বরের৷ একালে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের স্কুল পরিচালকেরা অনেক সময়েই ‘সংখ্যা’ হিসেবে চেনেন৷ নার্সারি ক্লাসের অমুক রোল নম্বরের পিছনে থাকা চার বছরের মানুষটিকে ‘মানুষ’ হিসেবে চেনার কোনো দায় তাদের নেই৷ সরকারি সমীক্ষা জানিয়েছিল শিশুদের জন্য বাড়ি, কর্মক্ষেত্র, হোম ইত্যাদির তুলনায় অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থান স্কুল৷ কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনা অন্য কথা বলছে৷ জিডি বিড়লা স্কুলে দুই ফিজিক্যাল এডুকেশন শিক্ষকের চার বছরের শিশু এক ছাত্রীর উপর নির্যাতনে, জ্বরের ঘোরে, ট্রমায়, ভয়ের থরথর কাঁপনে সে ঢুকে গেল এক অন্ধকারের দিনকালে৷ চারপাশে প্রায় রোজই এমন কিছু ঘটনা, আমাদের মনুষ্যত্বের ভিত নড়িয়ে দেয়৷ এদেশে প্রতি তিনটির মধ্যে দুটি শিশু শারীরিক নিগ্রহের শিকার৷ প্রতি দুটির মধ্যে একটি শিশু বীভৎস ধরনের যৌন হিংসার শিকার৷ এ কোন পৃথিবীতে বাস করছি আমরা৷ শিশুরা ভোটব্যাংক নয় বলে কি তাদের অধিকারের দাবিসনদ থাকবে না৷ কেন এই হিরণ্ময় নীরবতা?

ছোটো থেকে শিশুদের শেখানো হয় প্রশ্নহীন আনুগত্য, দ্বিধাহীন বশ্যতা৷ আবার তাদের আমরাই পড়াশুনো থেকে নাচগান সব কিছুতেই ইঁদুর দৌড়ের দিকে ঠেলে দিই, খেলার মাঠ থেকে স্কুল বাসে হট্টগোলের আনন্দটুকু কেড়ে নিই, মাস্টারমশাইয়ের স্নেহের স্পর্শকে ‘ব্যাড টাচ’ বলে শেখাই, ডিমদাদু থেকে পেপার কাকু সববাইকে অবিশ্বাস করতে বলি৷ শিশুর সঙ্গে কিছু ঘটলেই বকাঝকা, মারধর বা ‘কেন অন্ধকার কোণায় গিয়েছিলি?’ অথবা ‘ইস্কুলে বাথরুম চেপে থাকবি, তবু বাথরুমে যাবি না’ বলা কত বড়ো ভুল! যে কারণে কিছু ঘটলেও বাচ্চারা অনেক কিছু বাবা-মায়ের ভয়েই চেপে যেতে চায়, যতক্ষণ না ফ্রকে রক্তের ছোপ পড়ে৷ এই হল আমাদের সমাজের বাস্তবতা৷ এই ব্যবস্থা বদলাতে হলে শিশুদের কথা শুনতে, শিখতে হবে৷ শিশুকে অবাধ্য হতেও শেখাতে হবে৷ শিশুদের তর্ক করতে দিতে হবে, বলতে দিতে হবে৷ তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে৷ ছোটোরা নিজেরা সমর্থ না-ই হতে পারে৷ কেননা তাঁরা ছোটো, তাদের মধ্যে কাজ করে ভয়, সন্দেহ, লজ্জা৷ সেই সুযোগটা নিয়েই তো অপকর্মটি হচ্ছে৷ সচেতনতার দায় শিশুদের থেকে আমাদের অনেক বেশি৷ শিশুদের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে হলে শর্টকাট কোনো উপায় নেই৷
আমরা তাৎক্ষণিকভাবে যা যা চাইছি, তা তো মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া৷ কেউ কেউ বলছেন লিঙ্গচ্ছেদ চাই, কেউ বলবেন গণপিটুনি৷ এগুলি আবেগের প্রতিফলন৷ আমরা অনেকেই জানি না পকসো-র কথা৷ বেশিদিন নয় ২০১২ সালেই আইনে পরিণত হয়েছে ‘প্রোটেকশন অব চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস অ্যাক্ট’ (সংক্ষেপে ‘পকসো’)৷ আমাদের দেশে ধর্ষণ সহ যাবতীয় যৌন নিগ্রহের তদন্ত এবং বিচারপ্রক্রিয়া চলাকালীন নিগৃহীতের প্রতি অসম্মানজনক আচরণগুলির শিকার কোনো শিশুকে যাতে না হতে হয়, ‘পকসো’ প্রণয়নের সময় সেদিকে বিশেষ লক্ষ রাখা হয়েছিল৷ কিন্তু মুশকিল হল, আইনটির যথাযথ প্রয়োগের ব্যবস্থাদি করা দূরস্থান৷ আইনটির ব্যাপারে জনসাধারণকে সচেতন করার বিশেষ কোনো উদ্যোগ এখনও পর্যন্ত চোখে পড়েনি৷ তবে সেকালে যেসব নির্যাতন চলে যেত ফিশফিশ করে বলা নিষিদ্ধ গসিপের আওতায়, আজ তা সর্বসমক্ষে আনছেন শিশুদের বাবা-মায়েরাই৷ এটা একটা সদর্থক দিক৷