অলঙ্কারতি

মাঠে আর ঘাটে খেটে খুঁটে সমুদ্র পারাপার করে যে বাঙালি লক্ষ্মীকে অচঞ্চলা করে রেখেছিল গোলায় আর গুলবদনে, সেই বাঙালির জীবনে কবে থেকে অলক্ষ্মী ভর করল যে কোজাগরির পর... লিখছেন সুস্মিতা সোম
সেই মেয়েটা— যার মাথায় ছিল এক ঢাল কালো চুল৷ এই সুলক্ষণা চুলই ছিল তার শ্বশুরবাড়ির চৌকাঠ পেরোনোর অন্যতম ছাড়পত্র৷ আর স্বামীর জোব্বায় সোনার নাথনি৷ বিয়ের সময় এটি পরবার সময় স্ত্রীকে কথা দিতে হল স্বামীর সৌভাগ্য ডেকে এনে আরও ওজনদার নাথনি সে পরবে৷ হলও তাই৷ বিয়ের পর স্বামী একটু একটু করে উন্নতির দিকে এগোন আর স্ত্রীর নাকছাবিতে যোগ হয় আরও ওজনদার সোনা৷ এইরকম কয়েকটি উন্নতির ফলাফলেই মেয়েটির নাকের এপ্রান্ত ওপ্রান্ত কেটে রক্তারক্তি৷ মেয়েটি পালিয়ে এল বাপের বাড়িতে৷ কিছুদিন যেতে না যেতেই খবর এল বৌয়ের পয়ে আবারও উন্নতি হয়েছে শ্রীযুক্ত স্বামীর৷ সুতরাং আরও ওজনদার নাথনি নিয়ে তিনি আসছেন তার লক্ষ্মীমন্ত বউকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে৷ এটি গল্প হলেও সত্যি৷ গল্পটি পড়া ছিল, দেখা গেল উত্তরাখণ্ডের একটি প্রাচীন মন্দির চত্বরে৷ সেখানে উন্নতির খবরে আহ্লাদিত সত্তোরোধর্ব স্বামীর সাথে স্ত্রী এসেছেন বিরাশি সিক্কা ওজনের নাথনিতে বিয়ের কনের সাজে সেজে৷ এক নয় শ’য়ে শ’য়ে দম্পতি৷ সিমলার ম্যালে একবার করবা চৌথ-এ বাড়ির বৌদের গয়নার প্রদর্শনী দেখবার সৌভাগ্য হয়েছিল৷ কার্তিক মাসের সিমলা পাহাড়ে তখন কনকনে উত্তুরে হাওয়া৷ আমরা যারা শখের ভ্রমরী, শীতের সবরকম সরঞ্জাম গায়ে চাপিয়েও ঠকঠক কাঁপছি, হিমাচল সুন্দরীদের তখন দেখা গেল খোলা পিঠে ট্যাটু এঁকে এলায়িত চুলে কোনোরকম বাড়তি পোশাক ছাড়াই গা ভরতি গয়না পরে ম্যালের রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ অত গয়না অতজনকে এক সাথে পরে ঘুরে বেড়াতে আমি কোনোদিনই দেখিনি, দেখার কথাও নয় অবশ্য৷ হোটেলের মালিককে জিজ্ঞেস করায়, সেও গর্বের সাথে উত্তর দিয়েছিল, এতো হতেই হবে বউরা গয়না না পরলে রোজগারের আনন্দই বা কী, অহংকারই বা কী! আজ রাস্তায় দেখা হলেই পরিচিতরা গয়না দেখবে, দেখাবে আর বলবে এবারে প্রাপ্তির তালিকায় কী কী আছে৷ সারাদিন উপবাসের পর স্ত্রীরা স্বামীর পা ধুঁইয়ে দেবে, চাঁদের আলোয় মুখ দেখে সোনার মত উজ্জ্বল আর দীর্ঘায়ু কামনা করবে৷ তোমাদের বুঝি এরকম কোনো পার্বণ নেই? মাথা চুলকোই আমি৷ আছে, তবে ঠিক এইরকম...৷ ভাবলাম, ঠিকই তো কিছু ক্রয় করতে হলে কিছু তো ব্যয় করতেই হবে৷ আমরা বাঙালিনীরা যতই কেন গয়নার দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলি, বিজ্ঞাপনের সালঙ্কৃতা যুবতিকে দেখে বয়ে যাওয়া যৌবনের দুঃখে কাতর হই, যতই রাতের সুখনিদ্রা কেড়ে নিক অমুক বৌদির নতুন কালেকশনটা - সোনাকে আপন করে নেওয়ার জন্য কোনোরকম সাধ্যি সাধনা আর ত্যাগ - তিতিক্ষের জোর আছে কী? ‘দাসী করি মোরে রাখ পদতলে’ - হলমার্ক দেওয়া এই মন্ত্র কি একবারও উচ্চারণ করেছি অন্তত মনে মনেও৷ দুঃস্বপ্নেও কি এইরকম কোনো ভাবনাকে প্রশ্রয় দিয়েছি যে, এই শাখা সিঁদুরেই আমার অক্ষয় স্বর্গবাস? তা নয়, কেবল ঘ্যানর ঘ্যানর এই গুষ্টির জোয়াল ঘাড়ে করেই আমার সম্ভাবনাময় জীবনটা ছারে-খারে গেল৷ এইরকম মনের মেঘ নিয়ে কি আর লক্ষ্মী লাভ করা যায়! এই লক্ষ্মী মানেই সোনা, আর সোনা মানেই লক্ষ্মী৷ আর সোনা যে অঘটন ঘটন পটীয়সী সে কথা অস্বীকার করবে কোন আহাম্মক৷ আবার এই সোনাই যে সোনার হরিণের মতো পলাতক সে কথাও বাঙালির চাইতে আর কে বেশি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে! মাঠে আর ঘাটে খেটে খুঁটে সমুদ্র পারাপার করে যে বাঙালি লক্ষ্মীকে অচঞ্চলা করে রেখেছিল গোলায় আর গুলবদনে, সেই বাঙালির জীবনে কবে থেকে অলক্ষ্মী ভর করল যে কোজাগরির পর কয়েকদিনের তফাতেই তাকে মাততে হল ধনলক্ষ্মী ক্রয়ের আরাধনায়? সেই দুর্দিন কি বাঙালি অনুভব করেছিল পলাশির যুদ্ধের পর, যেদিন গঙ্গার বুকে সারি সারি গয়না নৌকা ভরতি সোনার মোহর নজরানা দিয়েছিল মীরজাফর? নাকি অজন্মা, অনাবৃষ্টি, নাকি নগ্ন হওয়ার লজ্জায় কাঁটাতারের ঘোমটায় মুখ ঢাকা ছিন্ন বাঙলার সীমান্ত, নাকি... নাকি...৷ এ অঙ্ক বড় কঠিন, মেলোনো শক্ত৷ তার চাইতে চেয়ে চেয়ে দেখো সারাদিন হাজারে হাজারে সেনার শক্ত কফিনে চেপে প্রবেশ করছে কত কত সোনা, এই শত অচ্ছেদ্দার শহর কেমন সেজে উঠছে মোহময়ী স্বর্ণদ্যূতিতে৷ এই জাদুস্পর্শেই তো ঘুম ভাঙবে যক্ষপুরীর রাজার৷ সেজে উঠবে রাজকুমারীর জৌলুশ৷ যে উজ্জ্বল বিভায় প্রাণ ফিরে পাবে ফিকে হয়ে আসা উৎসবের তাৎপর্য৷ সুতরাং কোনো প্রশ্ন নয়৷