মালদার জঠর জাত অগ্নি-উচ্চারণ - বন্দে মাতরম
top of page

মালদার জঠর জাত অগ্নি-উচ্চারণ - বন্দে মাতরম

১৯৮৪ সাল ১৫ অগাস্ট৷মালদা জেলার শীর্ষ প্রশাসনিক চত্বরে পতাকা উত্তোলন করছে জেলা সমাহর্তা বিজয় চট্টোপাধ্যায়৷ভাবগম্ভীর সেই পরিবেশে তিনি তাঁর বক্তব্যে বললেন, ‘...এই বিষয়ে আমরা আরও কিছুদূর অগ্রসর হয়ে বলতেই পারি মালদা জেলার ভূমিতেই সৃষ্টি হয়েছিল- বন্দে মাতরম, যার রচয়িতা বিখ্যাত সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়৷যে গানের অন্তর্নিহিত ঐতিহাসিক অনুভব ও আবেদনে উজ্জীবিত হয়েছিল স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া দেশের মানুষ৷(ইংরেজি ভাষণের বাংলা অনুবাদ)


উপস্থিত সকলের সেদিন কেউ বিশ্বাস করেছিল, কেউ বা করেনি৷কিন্তু স্বাধীনতার সিদ্ধিলাভে মালদার মাটি ছুঁয়েই শক্তি সঞ্চয় করে বন্দে মাতরম সঙ্গীতটি প্রাণরসে উজ্জীবিত হয়েছিল এই অহংকারের বৃন্ত থেকে চ্যুত হবার কোনো কারণ আজও ঘটেনি৷


Bankimchandra

১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে ভারতে এলেন ছোটোলাট লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার জর্জ ক্যাম্বেল৷রাস্তা নির্মাণ এবং নতুন নতুন খাল কাটার জন্য তিনি চালু করলেন ‘বেঙ্গল রোড সেস অ্যাক্ট’৷ প্রাথমিকভাবে এই কর আদায়ের জন্য চিহ্নত হল সাঁওতাল পরগনা, সিংভূম, চট্টগ্রাম, পার্বত্য অঞ্চল ও দার্জিলিং৷অচিরেই প্রভূতলাভের মুখ দেখল ব্রিটিশ শাসক৷ফলে বাংলার অন্যান্য জেলাগুলিকে এই করের আওতাধীন করে আনার জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হল৷সিদ্ধান্ত নিলেন পরবর্তী গভর্নর স্যার রিচার্ড টেম্পল৷এই সময় প্রতিটি জেলায় ‘বেঙ্গল রোড সেস অ্যাক্ট’ কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে যে কার্যালয়গুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তৈরি করা হল ডেপুটি কালেক্টরের পদ৷এই পদের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে প্রথম মালদায় এলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়৷মালদায় তিনি থাকলেন ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ অক্টোবর থেকে ১৮৭৫-এর ২৩ জুন পর্যন্ত৷২৪ জুন থেকে পরবর্তী ৮ মাস ২৬ দিন খাতায়কলমে মালদায় থাকলেও স্বাস্থ্য ভঙ্গের কারণে রইলেন কলকাতায়৷


হ্যাঁ, শাসক সরকারের হয়ে কাজ তিনি যত্নের সঙ্গেই করেছিলেন৷কিন্তু আরও যত্নের সঙ্গে যেটা করেছিলেন সেটা হল- মালদা, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, জলপাইগুড়ি - এইসব জেলার অতীত ও সমসাময়িক কালের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থানের অনুপুঙ্খ ইতিহাস সংগ্রহ৷এই বিষয়ে তাঁকে সাহায্য করেছিল কালেক্টরেটের মহাফেজ খানার নথি এবং উত্তরবঙ্গের সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ৷উত্তরবঙ্গের একের পর এক ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক মন্বন্তর, নরহত্যা, উৎপীড়ন, লাগামছাড়া শোষণ, চরম আর্থিক সংকট, সামাজিক নিরাপত্তাহীন মানুষের যন্ত্রণায় তিনি আহত হচ্ছিলেন ক্রমাগত৷এরই পরিণামে ইংরেজ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে মালদা সহ এইসব অঞ্চলে কৃষক ও কারিগরিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যে বিদ্রোহ আরম্ভ হয় (১৭৬৩ থেকে ১৮০০ খ্রিঃ পর্যন্ত) যা কৃষক বিদ্রোহ, সন্ন্যাসী বিদ্রোহ নামে বিখ্যাত ছিল সেই খবরও তিনি রেখেছিলেন। এই বিদ্রোহ তুমুল আকার ধারণ করেছিল৷মালদা জেলাতেও তার আঁচ পড়েছিল যথেষ্ট৷উত্তরবঙ্গের সন্ন্যাসী বিদ্রোহের এই পটভূমিতেই লেখা হয় ‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাস৷মালদা থেকে বদলি হয়ে চলে যাবার চার বছর পর ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘আনন্দ মঠ’ লিখতে শুরু করেন৷যা প্রকাশিত হয় আরও দু’বছর পর ১৮৮২ তে৷‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্রটিকে সন্ন্যাসী বা ‘সন্তান’ দেশভক্তদের জাতীয় সংগীত হিসাবে স্থান দিয়েছিলেন৷পরে যা জাতীয় সংগ্রামের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মাতৃমন্ত্র ছিল এই গানটি৷


১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু মেলার প্রথম উদ্বোধন হল বিপুল উন্মাদনার সঙ্গে। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই মেলার মূল সুরটি বেঁধে দিয়েছিলেন ‘মিলে সবে ভারত সন্তান’ এই সংগীতের সুরে। সেই দিনেই ‘বন্দেমাতরম’ গানটির একটি সুস্পষ্ট ছবি আঁকা হয়ে গিয়েছিল সাহিত্য সম্রাটের মনের মণিকোঠায়৷

১৮৬৭-র পর কেটে গেল কতকগুলি বছর৷চাকরি সূত্রে বিভিন্ন স্থানে গমন ও নিরন্তর ইতিহাস অনুসন্ধান৷মালদায় থাকার দু’বছর পর বদলি হয়ে গেলেন হুগলি জেলায়৷সেখানেও প্রশাসনিক কাজ আর ইতিহাস সংগ্রহ চলল হাত ধরাধরি করে৷ এত বিচিত্রতার মধ্যেও ‘বন্দে মাতরম’ ও মালদা রইল একাত্ম হয়ে৷


নির্মলচন্দ্র চৌধুরি ‘বন্দেমাতরম’ আনন্দমঠ ও উত্তরবঙ্গ নিবন্ধে লিখেছেন, ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর বঙ্কিমচন্দ্র মালদার ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন এবং প্রায় দু’বছর সেখানে থাকার পর ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২০ মার্চ মালদা থেকে হুগলিতে বদলি হয়ে আসেন৷আনন্দমঠ লেখার কার্যকর বছর আগেই তিনি ‘বন্দেমাতরম’ সংগীতটি রচনা করেছিলেন৷মালদায় থাকার সময়ই এই গানটি যে লেখা হয়েছে সেই কথার স্বপক্ষে আরও একটি যুক্তি হল পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর একটি লেখা৷তিনি লিখেছেন, ‘কিঞ্চিত পরিণত বয়সে আনন্দমঠ লিখলেন৷বন্দেমাতরম গীতটি উহার বহুদিন পূর্বেই রচিত হয়েছিল’৷শ্রীঅরবিন্দ আরও পরিষ্কার করে বললেন, ‘এই বৎসর পূর্বে অর্থাৎ ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে বন্দেমাতরম সংগীত লিখিত হইয়াছে৷ওই সময়ে বঙ্কিমচন্দ্র মালদহের ডেপুটি কালেক্টর’৷শিক্ষাবিদ সুবোধ সেনগুপ্তও বললেন, ‘মালদায় বাসকালে বন্দেমাতরম রচনা করেছিলেন৷এ বিষয়ে সাহিত্য গবেষকদের নানারকম মতামত থাকলেও ১২৩ বছর আগের ঘটনা, মালদায় ও ঘটনার সমসাময়িক কেউ বেঁচে নেই৷এবিষয়ে বিভিন্ন মতামত প্রকাশ পেলেও এবং অন্য প্রমাণ সঠিকভাবে প্রকাশিত না হওয়ায় বন্দেমাতরম সংগীতটি বঙ্কিমচন্দ্র মালদায় বাসকালে লিখেছিলেন- এই তথ্য একেবারেই ভ্রান্ত, তা নয়’৷সুতরাং অন্য প্রমাণ ও তার প্রামাণ্যটা যাচাই হয়ে সামনে না আসা পর্যন্ত আমরা এই সত্যের সামনে দাঁড়াতেই পারি মালদার মাতৃ জঠরই এই শাশ্বত সৃষ্টির জন্মস্থান৷

বিজ্ঞাপন

Malda-Guinea-House.jpg

আরও পড়ুন

bottom of page