জিম ইসমাইল (Jim Ismail)

Feb 19, 2020

সত্যজিৎ রায়ের 'দেবী' এবং এই ধর্মান্ধ সময়ের সংলাপ

Updated: Feb 24, 2020

উনিশে ফেব্রুয়ারি, ১৯৬০। আজ থেকে ষাট বছর আগে মুক্তি পায় সত্যজিৎ রায়ের 'দেবী'। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা ছোটোগল্প ‘দেবী’ অবলম্বনে একই নামে সত্যজিৎ রায় এই ছবিটি নির্মাণ করেন। ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং ধর্মান্ধতা এই ছবির পশ্চাৎপট অথবা তারও বেশি কিছু। সমালোচনার মুখে পড়তে হয় তাঁকে। হিন্দুধর্ম অবমাননা করার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। সত্যজিৎ হয়ে ওঠেন সে'সময়ের 'গণশত্রু'।

ছবির প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের একটি জমিদার পরিবার। সময়কাল উনিশ শতকের মাঝামাঝি। সত্যজিতের প্রায় সবকটি পিরিয়ড-পিসের সময়কাল উনিশ শতকীয় বাংলা- সে 'জলসাঘর' হোক অথবা 'দেবী' অথবা 'চারুলতা'। এ এমন এক সময় যখন আমাদের ঐতিহ্যে যা কিছু অন্ধকার তাকে উনিশ শতকীয় আধুনিকতার আলোতে দেখা হচ্ছে। মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক-পুরুষপ্রধান সমাজে নবজাগরণের আলো এসে পড়ছে।

কাহিনিতে ফেরা যাক। গ্রামের জমিদার কালীকিঙ্কর। ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধি। সত্যজিৎ তাঁকে নির্মাণ করেছেন পরম মমতায়। তাঁর ছোটো পুত্র উমাপ্রসাদ শিক্ষিত নব্য যুবক। কলকাতাতে ইংরেজি পড়ে। জমিদার-পুত্র হয়েও, শিক্ষা শেষে বিদেশে চাকরির স্বপ্ন দেখে। কালীকিঙ্করের পুত্রবধূ তথা উমাপ্রসাদের স্ত্রী দয়াময়ী এই কাহিনির কেন্দ্রবিন্দু। এক রাতে কালীকিঙ্কর স্বপ্ন দেখেন, দয়াময়ী স্বয়ং দেবী কালীর অবতার। এই স্বপ্নকে ঐশ্বরিক ইঙ্গিত ভেবে তিনি দয়াময়ীর আরাধনা শুরু করেন। তার উপর দেবীত্ব আরোপ করেন। এই সময়টির নির্মাণ ভীষণ সুন্দর এবং সাবলীল। আগের ঘটনাপ্রবাহে আমরা জেনেছি যে জমিদার কালীকিঙ্কর দেবী কালীর বিশেষ ভক্ত, ধর্মাচরণ করেই তাঁর সময় কাটে। দয়াময়ীকে তিনি বিশেষ স্নেহ করেন। পুত্রবধূকে তিনি 'মা' ছাড়া সম্বোধন করেন না। কালীকিঙ্কর তাঁর পুত্রবধূকে বলেন- 'তুমি এলে, ঘর আমার আলো হয়ে উঠলো। এই বুড়ো বয়েসে নতুন করে যখন এমন মা পেলাম, সেও অবশ্য তাঁরই কৃপা; তখন তাকে ছেড়ে যাব কোথায়! কী বল মা?'

প্রাথমিক ফ্রয়েডপাঠ না থাকলেও দর্শকদের বুঝতে অসুবিধে হয়না যে, জমিদার কালীকিঙ্করের কালীভক্তি এবং পুত্রবধূর প্রতি অপার স্নেহ- এই দুয়ের মিশেলেই তিনি দয়াময়ীকে দেবী কালী রূপে স্বপ্নে দেখেন।

প্রাথমিক পর্বে শ্বশুরের কাণ্ডকারখানায় হতবিহ্বল দয়াময়ীর পায়ের আঙুল গুটিয়ে আসে। তার হাত দেওয়ালে আশ্রয় খোঁজে। এই আরাধনা তার উপর নির্যাতন হয়ে নেমে আসে। একসময় অসহায় হয়ে সে তার বৌদিকে বলে কলকাতাতে পাঠরত স্বামীকে চিঠি লিখে জানাতে। উমাপ্রসাদ গ্রামে ফিরে আসে। বাবার বিরুদ্ধে যায়, প্রতিবাদ করে। উমাপ্রসাদের কথায়, তার বাবার বিদ্যে পুরোনো, ‘তাঁর আর আমার মধ্যে এক যুগের ব্যবধান’। উচ্চশিক্ষার আলো, রামমোহনের ভাবাদর্শ, থিয়েটারে নবজাগরণ, আধুনিকতা তার চিন্তাকে তার বাবার প্রতিস্পর্ধী অবস্থানে নিয়ে আসে। “দেবী’তে উমাপ্রসাদ এবং ‘সমাপ্তি’তে অমূল্য দুই আধুনিক বিদ্যার্থী শহর থেকে গ্রামে ফেরে বহমান নদীপথে। তাদের নৌকার পাল বাতাসে জেগে ওঠে। জীবনের এক নতুন মূল্যবোধ জন্ম নেয়। ক্রমে আকৃতি লাভ করে। প্রতিবাদ করে। ‘দেবী’র সেই ঋজু প্রকৃতির অধ্যাপক উমাপ্রসাদকে অনুপ্রাণিত করার জন্য আপন জীবন প্রসঙ্গে চিত্ত স্বাধীনতার কথা শোনান। নেপথ্যে বাষ্পীয় শকটের শব্দ প্রকাশিত হয়। একটা নতুন গতিবেগের আভাস মেলে।” (1)

কাহিনিতে বাঁক আসে যখন কাকতালীয়ভাবে এক মৃত্যুপথযাত্রী বালক চরণামৃত পান করে বেঁচে উঠে। দয়াময়ী দ্বিধান্বিত হয়ে ওঠে, কালীকিঙ্করের ভ্রান্ত বিশ্বাস দয়াময়ীর মধ্যেও সংক্রামিত হয়। ভাবতে শুরু করে, ‘যদি আমি দেবী হই?’। ছবির এস্টাবলিশিং শটে দয়াময়ীকে দেখানো হয়েছিল আনন্দমুখর মুহূর্তে। আকাশে অন্ধকার ভেঙ্গে আতসবাজির আলো ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু যে মুহূর্তে তার উপর দেবীত্ব আরোপিত হয়, সে তার সজীবতা হারিয়ে ফেলে। ধর্মীয় কুসংস্কারের বদ্ধ জলাশয়ে দয়াময়ীও স্থানু হয়ে পড়ে। শেষপর্যন্ত এই ভ্রান্তবিশ্বাসের ফাঁদে বিপর্যয় ঘটে যায় যখন আদরের ‘খোকা’কে সে বাঁচিয়ে তুলতে পারেনা। তার দেবীত্ব মিথ্যে হয়ে যায়, টেনে আনে চরম ট্রাজেডিকে। শেষ দৃশ্যে দয়াময়ী উন্মাদগ্রস্ত হয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন নদী-প্রান্তরে মিলিয়ে যায়। এক দেবীর বিসর্জনে কাহিনির শুরু, অন্য দেবীর বিসর্জনে কাহিনির শেষ। “দেবী ও জলসাঘর শেষ হয় সরাসরি মৃত্যুদৃশ্যের যতিচিহ্নে। দুই মৃত্যু-দৃশ্যই প্রাসাদ থেকে সরে এসে নদীর কোলে। যেন জীবনচক্রের মূল স্রোতের সঙ্গে চরিত্র দুটি মিলিত হতে চায়। মৃত্যুর পূর্বে দুই চরিত্রের মধ্যে অনুভূত রিজেনারেশনের আর্তি।” (2)

অনেকে ‘দেবী’র সমাপ্তিকে ওপেন এন্ডেড মনে করেন। নানা জনের নানা মত। আমার মনে হয়, যুক্তি এবং ধর্মের সংঘাতে সত্যজিৎ মানুষের পক্ষ নিয়েছেন, জীবনের পাশে দাঁড়িয়েছেন। “দেবী’র এক বিশেষ মুহূর্তে ঘটনার আকস্মিকতায় উদভ্রান্ত উমাপ্রসাদ বাড়ির জীবনহীন পরিবেশ থেকে পালিয়ে আসে নদীর কূলে। তখন সন্ধ্যায় জেলের দল মাছ ধরে ফিরছে। অন্ধকার নদীর বুকে নৌকার সারিতে আলো জ্বলে উঠেছে। চিরন্তন জীবনপ্রবাহ চলেছে নীরবে। আবদ্ধ সময় থেকে সরে এসে যেন তার প্রতি চলচ্চিত্রকারের শ্রদ্ধা নিবেদন এখানে”। (3) জীবনবিমুখ ভক্তিতত্ত্বে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মন কিভাবে সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে এই ছবিতে সেটিই দেখানো হয়েছে।

শুরু থেকেই চলচ্চিত্র ধর্মকে গৌরবান্বিত করে এসেছে। ভ্রান্তবিশ্বাস, অন্ধভক্তি এবং পুরুষতান্ত্রিকতাকে মর্যাদা দিয়ে এসেছে। যে অন্ধ ধর্মীয় ভাবনা বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে তাকে বানিয়া চলচ্চিত্রকাররা তুষ্ট করতে চেয়েছেন। ফলে যে ধর্মের প্রধান লক্ষণ বাস্তববিমুখতা, চলচ্চিত্র তাকে বাস্তব বলে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু ‘দেবী’তে সত্যজিৎ প্রথমবারের মত বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। “ধর্ম, দেবতা, ঈশ্বর এসবের অস্তিত্ব প্রমাণসিদ্ধ নয়, তা কেবল বিশ্বাসনির্ভর, কোনো প্রত্যক্ষ সমালোচনা বা বিরুদ্ধতা ছাড়াই সত্যজিৎ দেখিয়ে দেন সেই বিশ্বাস বা দৈবীলীলার চেহারাটা, বুঝিয়ে দেন ধর্ম কীভাবে মানুষের বিচারবুদ্ধিকে পঙ্গু করে দেয়, অযৌক্তিক ও অসম্ভব ক্রিয়াকলাপের দিকে তাকে টেনে নেয়, তৈরি করে মিথ্যার আশ্রয়। সত্যজিৎ নাড়া দেন অনেক গভীরে, ব্যক্তি দয়াময়ী নয়, ধর্ম আসলে ঘনিয়ে তোলে মানবিকতার সংকট, সত্যজিৎ এভাবে দেখিয়ে দেন ধর্ম কেমন করে মানবিকতার শত্রু হয়ে ওঠে”। (4)

তাঁর এক সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ একবার বলেছিলেন, আমি বিশ্বাস করিনা, একটা ছায়াছবি সমাজকে বদলে দিতে পারে। ‘দেবী’ও পারেনি। ‘দেবী’র পরে ‘মহাপুরুষ’ (১৯৬৫) এবং ‘গণশত্রু’ (১৯৯০) পেরিয়ে এসেও এই সময়ে আমরা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে- এই একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল ভারতবর্ষে ধর্মকে কেন্দ্র করে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। বহু বছরের সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধ আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির গভীরে ঢুকে আছে, ধর্ম যার নিয়ন্ত্রক। দেব মাহাত্ব্য, আদারাইজেশন, ধর্মীয় আধিপত্যবাদ- এ সবই এখন ভারতীয় সংস্কৃতি। এমনকি দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবাদের মাপকাঠিও হয়ে উঠেছে ধর্ম। ধর্মকে কেন্দ্র করে সংখ্যাগুরু দেশবাসী জিঙ্গো-জাতীয়তায় উদ্বুদ্ধ। সংখ্যালঘুদের অভারতীয় বলে ‘অপর’ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া চরমসীমা অতিক্রম করে ফেলেছে।

‘জয় সন্তোষী মা’, ‘বাবা তারকনাথ’-এর মত বিজ্ঞানবিরোধী ছবি তৈরি হয়েছে এবং জনপ্রিয় হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর উপর দেবত্ব আরোপ করে নিকৃষ্ট ছবি তৈরি হচ্ছে। টিভিতে ধর্মীয় সিরিয়ালের আস্ফালন- অবাস্তব কাণ্ডকারখানা এবং অযৌক্তিক ভক্তি যার উপাদান। এই ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সরকারি অনুষ্ঠান হয় পঞ্জিকা দেখে, ধর্মীয় নির্দেশ মেনে। চলচ্চিত্র বা সিরিয়ালের মহরত হয় এবং হচ্ছে নারকেল ফাটিয়ে পুজো দিয়ে। প্রধানমন্ত্রী কুম্ভমেলায় স্নান করছেন, কপালে বীভৎস লাল তিলক দিয়ে নেতারা ঘনঘন মন্দিরে দৌড়াচ্ছেন। জ্যোতিষীদের কাছে আত্মসমর্পণ করছেন। সাধু-সন্তদের পদযুগল মাথায় ধারণ করছেন। ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সরকারি দপ্তরে, স্কুলে-কলেজে কোনও না কোনও দেব-দেবীর প্রতিমা অথবা তাঁদের মুখসহ একটি বা দুটি ক্যালেন্ডার ঝুলছে। রেলওয়ে স্টেশনের ভেতরে প্ল্যাটফর্মের অতি নিকটে একটি গাছ বা পাথরকে কেন্দ্র করে গজিয়ে উঠছে মন্দির। আফিমের নেশা কাটানোর বদলে আফিম যোগান দেওয়াতেই রাষ্ট্রের উৎসাহ।

তাই মুক্তির ষাট বছর পরেও 'দেবী' আরও বেশি প্রাসঙ্গিক এবং তাৎপর্যবহ। অথচ নব্বই মিনিটের প্রায় নিখুঁত এই ছবিটি, সত্যজিৎ রায়ের একটি আন্ডাররেটেড চলচ্চিত্র। তাঁর অন্যান্য চলচ্চিত্রগুলোর মত ‘দেবী’ নিয়ে খুব বেশি চর্চা হয়না। শেষ করব ‘দেবী’ সম্পর্কে উৎপল দত্তের বক্তব্য দিয়ে। ‘বিদ্রোহী সত্যজিৎ’ নামে সেই প্রবন্ধে তিনি বলছেন, “আমার হিসেবে ‘দেবী’ একটি বৈপ্লবিক চলচ্চিত্র। আজ পর্যন্ত এদেশে যত ছবি তৈরি হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে প্রচণ্ড, আপসহীন এবং সুদূরপ্রসারী। এখানে শিল্পী হেঁচকা টান মেরেছেন মনের সবচেয়ে গভীরে রোপিত ও রক্ষিত মূলটি ধরে- ধর্ম”।

তথ্যসুত্রঃ

  1. মুখোপাধ্যায় দিলীপ, ১৯৮৬, সত্যজিৎ, বাণীশিল্প, কলকাতা।

  2. মুখোপাধ্যায় দিলীপ, ১৯৮৬, সত্যজিৎ, বাণীশিল্প, কলকাতা।

  3. মুখোপাধ্যায় দিলীপ, ১৯৮৬, সত্যজিৎ, বাণীশিল্প, কলকাতা।

  4. বসুরায় ইরাবান, ২০১৮, 'ধর্ম ও চলচ্চিত্র', সিনেমা ও কিছু অনান্দনিক ভাবনা, বৈভাষিক প্রকাশনী, হুগলি।