জিম ইসমাইল (Jim Ismail)

Jan 27, 2018

পদ্মাবতী: রাজপুত ভাবাবেগকে আঘাত করেনি, আসল ছবিটা বরং উলটো!

Updated: Mar 28, 2023

যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে নয়, এবার যত কাণ্ড ভারতবর্ষে। একটা ছবির মুক্তি ঘিরে এত বিতর্ক-আন্দোলন, হুমকি, আইন-আদালত, এত উত্তেজনা বোধহয় ভারতবর্ষ আগে দেখেনি। সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশানের সৌজন্যে সঞ্জয় লীলা বনশালির 'পদ্মাবতী' কে বাধ্য করা হল 'পদ্মাবত' হতে, বাদ গেল কিছু দৃশ্যও। শেষ অবধি গত পঁচিশে জানুয়ারি ছবিটি মুক্তি পেল ঠিকই, কিন্তু শেষরক্ষা হল না। এই প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে আমি যখন ছবিটা নিয়ে লিখছি, তখন উত্তর ভারত জুড়ে যে দাঙ্গা পরিস্থিতি তাতে মনে হচ্ছে ভারতবর্ষে 'প্রজাতন্ত্র' নিছকই প্রতীক, আসলে দেশজুড়ে 'গুন্ডাতন্ত্র' চলছে। কিন্তু যে ব্যাপারটা নিয়ে এত বিতর্ক, ছবিটা নাকি দেশের রাজপুত সম্প্রদায়ের ভাবাবেগকে আঘাত করেছে, সত্যিই কি আছে তেমন কিছু? — না, সারা ছবি তন্নতন্ন করে খুঁজলেও তেমন কিছু পাওয়া যাবে না, আসল ছবিটা বরং উলটো।

১৩ শতকের রাজস্থান। মেবারের রাজপুত রাজা রাওয়াল রতন সিংহ (শাহিদ কপূর) তাঁর প্রথমা স্ত্রীর জন্য দুর্লভ মুক্তো আনতে সিংহলে যান। সেখানে গিয়ে সিংহলের রাজকন্যা পদ্মাবতীর (দীপিকা পাদুকোন) প্রেমে পড়েন। রাজার দোষ কি বলুন, পদ্মাবতী শুধু কি অপরূপা সুন্দরী, একদিকে সে কুন্তল কন্যা দেবসেনার মত শিকারি যোদ্ধা, আবার কিছুটা 'বাজিরাও মাস্তানি'র, মাস্তানির মত বুদ্ধিমতী। পদ্মাবতীকে তিনি বিয়ে করে নিয়ে এলেন। ইতিমধ্যে কাকা জালালউদ্দিনকে হত্যা করে দিল্লীর সিংহাসনে বসেছেন আলাউদ্দিন খিলজি (রনবীর সিং) যে মনে করে 'হার নায়াব চিজ পার আলাউদ্দিন কা হাক হে'। তো এহেন স্বৈরাচারী আলাউদ্দিনের কাছে পদ্মাবতীর সৌন্দর্যের খ্যাতির খবর পৌঁছোয়। পদ্মাবতীকে তাঁর চায়, শুরু হয় রাজায় রাজায় যুদ্ধ।

রানি পদ্মাবতী বা পদ্মিনী নামে কেউ ছিলেন এর কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। থাকলেও তাঁর জন্যই আলাউদ্দিন খিলজি ১৩০৩ সালে চিতোর আক্রমণ করেছিলেন, এ'কথা ইতিহাস বলেনা, রাজ্যের সীমানা সম্প্রসারণই ছিল তাঁর লক্ষ্য। কিন্তু এ'ছবিতে ইতিহাস খুঁজতে যাওয়া অবান্তর কারণ ছবির শুরুতেই অনেকগুলো ডিসক্লেমারের মাধ্যমে পরিচালক বলে দিচ্ছেন সব চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক। সুফি কবি মালিক মোহম্মাদ জয়সির মহাকাব্য 'পদ্মাবত' অবলম্বনে তৈরি তাঁর এই এপিক পিরিয়ড। এছাড়াও পুরো ছবি জুড়ে আছে বনশালির নিজস্ব কল্পনা।

এ ছবি নিয়ে করনি সেনাদের বনশালির উপর এখনও কেন এত রাগ তা বোধগম্য নয় কারণ করনি সেনারা যা চায় এ ছবি ঠিক তাই।রাজপুতদের 'আন বান শান' এই নিয়েই তো এই ছবির সরলরৈখিক আখ্যান। এ ছবি রাজপুতদের গৌরবের ছবি। ছবির এক জায়গায় রাজা রাওয়াল সিংহ বলে- 'চিন্তা কো তালওয়ার কি নোখ পে রাখে ও রাজপুত,রেত কি নাও লেকার সামুন্দার সে শর্ত লাগায়ে ও রাজপুত... আউর জিসকা সার কাটে ফির ভি ধড় দুশমন সে লাড়তা রাহে ও রাজপুত !''। রাজপুত জাতির আদর্শ, আত্মসম্মান আর গরিমা আকাশছোঁয়া, এমনকি রাজপুত রমণীদের 'কাঙ্গান মে উতনি হি তাকাত হে জিতনি রাজপুতি তালওয়ার মে '। হিন্দু রাজপুতদের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বনশালি মুসলমান খলজিদের দেখিয়েছেন 'আদার' বা 'অপর' হিসেবে।

সুস্থ বিচারবুদ্ধি এবং পরিমিতিবোধ সহ রাজা রাওয়াল রতন সিংহ একজন সভ্য হিন্দু রাজপুত রাজা। অন্যদিকে আলাউদ্দিন খলজি বাস করে এক আদিম জগতে, উন্মাদের ভুবনে। যেমন খুশি মানুষ মারে, চোখে সুরমা দেয়, আর জন্তুর মত মাংস খায়। সবমিলে খলজি একজন বর্বর, অত্যাচারী, বিশ্বাসঘাতক মুসলমান শাসক। এ'দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা, মুসলিমদের যেমন কামুক, বিশ্বাসঘাতক, যুদ্ধবাজ হিসেবে ভেবে এসেছে, বনশালি তাঁর এই ছবিতে সেই পপুলার ভাবনারই প্রতিধ্বনি করেছেন। বনশালির এই ঘৃণ্য, পাগলাটে, ধর্ষক খলজিকে পর্দায় জীবন্ত করে তুলেছেন রনবীর। বাড়াবাড়ি এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যে আলাউদ্দিন খলজি বলিউডি হিরোদের মত নেচেছে, গেয়েছে। খিলজির সঙ্গে মালিক কাফুরের (জিম সর্ভ) সমকামিতার একটা দিক পরিচালক দেখাতে গেলেন কেন বোঝা গেল না। ছবির একটি দৃশ্যে খিলজি আর মালিক কাফুর এক বাথটাবে, কিছুক্ষণ পরে মালিক কাফুর রুপী জিম সর্ভের ঠোঁটে গান গেয়ে ওঠে অরিজিত সিংহ। এই দৃশ্য ভীষণ হাস্যকর।

রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন, শিল্পকে সত্যনিষ্ঠ হতে হবে, তারপরে সৌন্দর্য নিষ্ঠ, বনশালি কবে এটা বুঝবেন!

সিরিয়াস দর্শকও খিল্লি করতে পারে এমন অনেক উপাদান আছে পদ্মাবতীতে। যেমন ছবির ক্লাইম্যাক্স অতিনাটকীয় আর চড়া দাগের। ক্লাইমাক্সে আত্মসম্মান রক্ষার উপায় হিসেবে জহর ব্রতকে গৌরবান্বিত করে দেখানোটা মেনে নেওয়া যায়না। এমনকি পতিব্রতা, সংস্কারি, ভারতীয় নারী পদ্মাবতী, জহরব্রত পালনের অনুমতি নেয় স্বামীর কাছ থেকে কারণ স্বামীর 'ইজাজাত' ছাড়া সে মরতেও পারবে না ! এইসব করতে গিয়ে পরিচালক অনেক সময় নিয়েছেন, স্লো মোশন ব্যবহার করেছেন। দর্শকের ক্লান্তি আসে। অবশ্য পুরো ছবি জুড়েই গল্পের বিষয়ে, অভিনেতাদের অভিনয়ে,এমনকি ব্যাকগ্রাউণ্ড স্কোরে এত রিপিটেশন যে প্রথমার্ধ থেকেই চোখে আলস্য আসে। ছবির অ্যাকশন দৃশ্যগুলি দাগ কাটতে পারে না। ঘুমর গানটি বাদ দিলে ছবির বাকি গানগুলো হাস্যকর। ছবির সময়ও অনায়াসে দু'ঘণ্টায় বেঁধে রাখা যেত।

আর আছে বনশালির সিগনেচার স্টাইল। ছবির প্রায় প্রতি ফ্রেম জুড়ে ভিজুয়াল ফ্যান্টাসি। সিনেমাটোগ্রাফার সুদীপ চ্যাটার্জির সাহায্যে তিনি দৃশ্যে মুগ্ধতার জন্ম দেন যেমনটা বনশালি তাঁর সব ছবিতে করে থাকেন। রঙের মায়াজালে চিতোর বর্ণময়! আলো, রঙ আর বিশাল বিশাল সেট তৈরি করে প্রাচীন মায়াময় পরিবেশ তৈরির চেষ্টা হয়েছে। হ্যাঁ চেষ্টা বলছি এই কারণে যে, রঙ আলো আর সম্পদের এই জৌলুস সত্ত্বেও ফ্রেমজুড়ে প্রাণহীনতা অনুভূত হয়। অনেক অর্থ অপচয় করে বিশাল সেট তৈরি হয়েছে কিন্তু সেগুলিতে স্পন্দন যেন কিছু কম ! এত আড়ম্বর সত্ত্বেও ছবিটা দর্শকদের মধ্যে শিল্পিত অভিঘাত তৈরি করতে ব্যর্থ। সব মিলে এই ছবি ধ্রুপদী ছবি হয়ে উঠতে পারেনি। শিল্পকে তুচ্ছ করে দিয়ে এপিকের গড়নটাই বড় হয়ে উঠেছে।

সৌন্দর্য, শক্তি, শিক্ষা, নীরব তেজ-এর পদ্মাবতীর চরিত্রে দীপিকা ভাল। আগের ছবিগুলোতে বনশালি দীপিকার চরিত্রকে যত্ন করে তৈরি করেছিলেন। কিন্তু এ'ছবিতে দীপিকাকে ভাল সাজিয়েছেন কারণ একগাদা গয়না আর কস্টিউম পরে সেজে থাকা ছাড়া দীপিকার এ'ছবিতে বিশেষ কিছু করার ছিলনা। দীপিকার সৌন্দর্য বা অভিনয় এ ছবিতে অন্য কোন মাত্রা যোগ করতে পারেনি। দীপিকার চেয়েও করুণ দশা শাহিদ কাপুরের,তাঁরও কিছু করার ছিলনা। পুরো ছবি জুড়ে এক ভঙ্গি ধরে রাখতে হয়েছে তাকে আর মাঝে মাঝে রাজপুত ঐতিহ্য আর গরিমার কথা দর্শকদের মনে করিয়ে দিয়েছেন গরমগরম সংলাপে। না আর একটি কাজও শাহিদকে করতে হয়েছে, বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে দীপিকাকে 'ইনটেন্স লুক' দিয়ে যেতে হয়েছে। দুঃখের বিষয় তারপরও শাহিদ আর দীপিকার রসায়নটা জমাট বাঁধেনি।

১৯২৪ সালে 'নাচঘর' পত্রিকায় সৌরিন্দ্রমোহন মুখার্জি বলেছিলেন- 'ফিল্মকে আর্টিস্টিক করিতে হইলে সর্বাগ্রে চাই গল্পের সুসামঞ্জস্য বিকাশ ও তার অভিনয় মনস্তত্ত্বের নিখুঁত লীলা'। পদ্মাবতী এই দুটো দিকেই ব্যর্থ। ছবির গল্প একরৈখিক-রাজপুত ঐতিহ্য, পুরাণ আর সংস্কৃতি। রাজপুতরা বীর আর সাহসী দেশপ্রেমিক। সমস্ত চরিত্রগুলো তালগাছের মত ঋজু রেখায় আকাশের দিকে উঠে গেছে, বৈচিত্র্য নেই। গল্পে কোন বাস্তবমুখী দ্বন্দ্ব নেই যাতে করে গল্পের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ ঘটতে পারে। রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন, শিল্পকে সত্যনিষ্ঠ হতে হবে, তারপরে সৌন্দর্য নিষ্ঠ, বনশালি কবে এটা বুঝবেন!

আমাদের মালদা এখন টেলিগ্রামেও। জেলার প্রতিদিনের নিউজ পড়ুন আমাদের অফিসিয়াল চ্যানেলে। সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
 

 
(মুভি পোস্টার সৌজন্যেঃ বলিউড হাঙ্গামা ডট কম)