আমাদের মালদা ডিজিট্যাল

Mar 21, 2019

হোলি খেলিব শ্যাম তোমার সনে

Updated: Apr 7, 2023

শিপ্রা বসাক ভৌমিক

বসন্ত এসে গেছে, প্রবল বসন্ত৷ শিমুল-পলাশের ডালে আগুনের ছটা৷ মাতাল হয়েছে মহুল বন, কোকিলের পাগলপারা ডাক - পলাশবৃতির উপর কিশোরীর উজ্জ্বল ঠোঁটের লাল আভা৷ আম্রমুকুলের মধু পান করে মাতাল মৌমাছি, বাতাসে কী ভীষণ মন কেমন করা টনটনানি৷ হাতে ধরা মুঠোফোনে টাংটাং করে ঢুকতে শুরু করেছে হোলির শুভেচ্ছা - দোলের ফাগ আর মালপোয়া মিষ্টির সম্ভার৷ ভালোবাসার ফাগে রাঙিয়ে দাও তোমার প্রিয় মানুষটিকে৷

হর্ষবর্ধনের রত্নাবলীতেও এই উৎসব পাওয়া যায় সাতশো খ্রিস্টাব্দে

বৃন্দাবনে ফাগু খেলত শ্যাম বিষ্ণুপ্রিয়া সঙ্গে/ কুমকুম মারত দুঁহু দোহা অঙ্গে৷ যামিনীর পূর্বমীমাংসা সূত্রের তথ্য বলছে, আর্যাবর্তে বিশেষ করে পূর্ব ভারতের উৎসব হোলি উৎসব- বসন্ত ঋতুর উৎসব৷ ফাল্গুনের চাঁদ পূর্ণ হলে বসন্ত মহোৎসব বা কামো মহোৎসব শুরু হত৷ বেদ, নারদ পুরাণ ও ভবিষ্যপুরাণে হোলি উৎসব পাওয়া যায়৷ খ্রিস্টের জন্মের তিনশত বছর আগে বিন্ধদেশের রামগড়ে একটি প্রস্তর লিপিতে হোলিকোৎসবের কথা পাওয়া যায়৷ হর্ষবর্ধনের রত্নাবলীতেও এই উৎসব পাওয়া যায় সাতশো খ্রিস্টাব্দে৷ হোলি উর্বরতা, রং, আনন্দ, অশুভ বিনাশকারী ও শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠার উৎসব৷ বিষ্ণুপুরাণ বলছে, রাজা হিরণ্যকশিপু বিশ্বাস করতেন তিনিই স্বয়ং ভগবান৷ সকলে তাঁকে পুজো করবে৷ এদিকে রাজা হিরণ্যকশিপুর পুত্র ভক্ত প্রহ্লাদ বিষ্ণু ছাড়া কাউকে পুজো করতেন না৷ পুত্রের এহেন উদ্ধত দেখে রাজা পুত্রকে শাস্তি দিতে চান৷ হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকা ছিলেন ভয়ংকরী নিষ্ঠুরা রাক্ষসী রমণি৷ তিনি জানতেন, অগ্নিদেবতার বরে কখন আগুন তাকে পুড়াতে পারবে না৷ তাই ভক্ত প্রহ্লাদকে নিয়ে তিনি অগ্নিতে প্রবেশ করলেন পুড়িয়ে মারবার জন্য৷ বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদ ভগবান বিষ্ণুর আশীর্বাদে জ্বলন্ত অগ্নি থেকে রক্ষা পেলেন৷ কিন্তু ভয়ংকরী হোলিকা প্রজ্বলিত অগ্নিতে জ্বলে পুড়ে মরলেন৷ অশুভ শক্তির বিনাশ হয়ে আনন্দের উৎসব হয়ে উঠল হোলি উৎসব৷

ব্রজধাম বৃন্দাবনে আনন্দই আনন্দ৷ ব্রজবাসীগণ রাধাকৃষ্ণের সাথে দোলে কুঞ্জ বনে ফুল ফাগ আবিরের দোলায় দুলতেন - সখী সহ শ্যাম রাধা বিলাসিনী অঙ্গে অঙ্গে ভাব বিভঙ্গে গেয়ে উঠতেন হোলি খেলিব শ্যাম তোমার সনে/ কুমকুম মারিব তোমার রাঙ্গা চরণে৷

এই উপমহাদেশেই যে শুধু হোলি উৎসব, তা নয়৷ শীত গেল - বসন্ত এল - বসন্তে পাতা গজাল - প্রকৃতির নবজন্ম হল - এই বিশ্বাস থেকে খ্রিস্টানরা ‘পগান’ অর্থাৎ ‘ইস্টার’ পালন করে থাকেন৷

জার্মানিতে হোলি উৎসব নানা রং-এ সেজে ওঠে৷ জার্মানরা বিভিন্ন মুখোশ দিয়ে ছদ্মবেশ ধারণ করে সমস্ত গায়ে লাল-কালো নানা রং মেখে লাফালাফি করে তামাশা করেন৷ এখানে হোলিতে নূতন বছরের সূচনা হত৷ দোল উৎসব কোনও সংকীর্ণ সীমাবদ্ধ উৎসব নয়৷ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছিলেন, দোল ঋতুর উৎসব৷ শুধু হিন্দুর উৎসব নয় - সমস্ত মানবজাতির উৎসব৷ আদি কলকাতার দোল কেমন হয় ওই প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, সব হিন্দুর বাড়িতে মেড়া সাজানো হইল - সন্ধ্যাটি হইল আর ছেলেরা উন্মত্ত হইয়া মেড়ায় আগুন লাগাইতে লাগিল৷ তাহারা নাচিতে লাগিল, গাইতে লাগিল, হাততালি দিতে লাগিল আরও কতরকম বাঁদরামি করিতে লাগিল- চতুর্দশীর চাঁদ উঠিল - আগুন তখনও নিভে নাই৷

এ বাড়ির ছাদ থেকে হাতের অব্যর্থ টিপে রংভরা বেলুনটি প্রেমিক দেওর ছুড়ে মারত রাঙা বউদির রান্নাঘরে

প্রাণকৃষ্ণ দত্ত সেই সময়ের কলকাতার দোলের অভব্যতার কথা লিখেছেন, ‘দোলের মিছিলে কোনও ব্যক্তি বেদাগ থাকিতেন না৷ দলে দলে মিছিলে পিচকারী আবিরে পথঘাট লাল হইয়া যাইতেছে৷ মিছিলওয়ালারা পুশ্রাব্য অশ্রাব্য গীতে পাড়া মাতাইয়া সং সাজাইয়া চলিতেছেন৷ কর্তা, গিন্নি, বালক, বালিকা সহ সে সব শ্রবণ করিয়া বড়ো আমোদ করিতেন’

বসন্ত এসে গেছে, প্রবল বসন্ত৷ অনলাইন মোবাইল চ্যাটে মেতেছে দোল উৎসব৷ বিশ্বাস করুন আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি এপাড়ার দোলের মিছিল ওপাড়ার রাস্তায় রাস্তায় গেয়ে বসন্ত জানিয়ে মনে ও শরীরে রং লাগিয়ে দিয়ে আসত৷ এপাড়ার বাসন্তী ছাদ অথবা বারান্দার ব্যালকনি থেকে সলজ্জ চোখে ও পাতার বীরুকে মন ভরে দেখে রাঙা হয়ে উঠত৷ এ বাড়ির ছাদ থেকে হাতের অব্যর্থ টিপে রংভরা বেলুনটি প্রেমিক দেওর ছুড়ে মারত রাঙা বউদির রান্নাঘরে৷ বউদির পিঠ একেবারে লাল-সবুজে রাঙিয়ে মনে গুনগুনিয়ে উঠত ফাগুয়ার প্রেম৷ এখন আপনি হোয়াটসঅ্যাপের, ফেসবুকের মালপোয়াতে সন্তুষ্ট থাকেন৷ সত্তর আশির দশকে পড়শি কিশোরেরা চোখে সলজ্জ আবেদন নিয়ে চার বোনের বাড়িতে এসে ঠোঁট তৈলাসক্ত করে মালপোয়া খেয়ে মাসিমার আশীর্বাদ নিয়ে যেত৷ সন্ধে হলে একদিকে হিন্দুস্তানি সুর উঠত ছ্যা রা রা রা হোলি হ্যাঁয় - অন্যদিকে বোতলে টুংটাং আওয়াজ তুলে ইতিউতি ঠেক সেজে উঠত৷

বসন্ত এসে গেছে, প্রবল বসন্ত আসন্ন লোকসভা নির্বাচন সেজে উঠেছে৷ টিকিট পাওয়া বড়দা-বড়দিরা বসন্ত বাতাসে হোলির ফাগ উড়িয়ে দিয়ে ভারী অমায়িক হয়ে উঠেছেন৷ গ্রামে গঞ্জে, শহরে, বড়ো গলি, ছোটো গলি ঘিঞ্জি বস্তি সর্বত্র হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ ও সাদা পাঞ্জাবিতে প্রীতি ও শুভেচ্ছার রং মেখে সবুজ, হলুদ, লাল, নীল, গোলাপি ফাগ উড়িয়ে আপ্লুত হয়ে উঠছেন - ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল৷

পাড়ায় পাড়ায় সংস্কৃতি সচেতন শোভাযাত্রায়, পদযাত্রায় রাবীন্দ্রিক সুরে বাজিয়ে দিয়ে যাও - যাও গো এবার - জলে স্থলে বনতলে লাগলো যে দোল - বসন্ত এসে গেছে-প্রবল বসন্ত৷

ছবিঃ মিসবাহুল হক

আমাদের মালদা এখন টেলিগ্রামেও। জেলার প্রতিদিনের নিউজ পড়ুন আমাদের অফিসিয়াল চ্যানেলে। সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন