সৌম্য দে সরকার

Mar 1, 2017

লক্ষ্মী ঘর ছেড়েছেন আগেই। নবীনও এখন প্রবীণ। এবার বিবর্ণ বিচিত্রা

Updated: Feb 25, 2023

লক্ষ্মী ঘর ছেড়েছেন আগেই। অবশ্য বিগত তিরিশ বছরে লক্ষ্মী ঘরে টিকেছিলেন লছমী হয়ে। তা সেই লছমী-র গণেশ ওলটানোরও নেই নেই করে প্রায় বছর দুয়েক হতে চলল। রূপকথাও আছড়ে পড়েছে কঠোর নেতিবাচক বাস্তবে। নবীনও এখন প্রবীণ হয়ে নাকি দিন গুনছে। এবার বিবর্ণ বিচিত্রা।

গ্রীষ্ম দুপু্রে চলমান রিকশায় সিনেমার ঘোষণা স্মরণে আছে শুধু চল্লিশোর্ধ প্রজন্মের। ভিডিয়ো হল, ভিসিপিও বোধহয় এতটা বিপন্ন করেনি মফস্‌সল শহরের রূপালি পর্দাকে। জানুয়ারির মাঝামাঝি একটা ফেসবুক পোস্ট পড়েই খানিকটা বিস্ময়, অনেকটা সাংবাদিকোচিত কৌতূহল আর একটা আন্তরিক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে দ্রুত যোগাযোগ করেছিলাম দেবাশিসদার (জোয়ারদার) সঙ্গে। মিনিট কুড়ির কথোপকথনে যেটা উঠে এল তাকে সংক্ষেপে বলা যেতে পারে অসহায় কিছু তথ্য। সব মিলিয়ে একটা ডাবল কলাম নেমে গেল কিন্তু যা ছিল আগের মতো রয়ে গেল।

ষাটের দশকে প্রাক্তন সাংসদ ও বিধায়ক এবং একই সঙ্গে আন্তরিকভাবে সংস্কৃতিপ্রবণ (কম্বিনেশনটা ভীষণ রেয়ার) দীনেশ জোয়ারদার অ্যান্ড ব্রাদার্স-র হাত ধরে মালদা পেল বিচিত্রা। তখন সিনেমা হল এবং প্রেক্ষাগৃহ শব্দদুটো একইরকম জনপ্রিয়। সেই সময়ের তুলনায় খানিকটা এগিয়ে গদি আটা চেয়ার, গমগমে আওয়াজ ইত্যাদি নিয়ে বিচিত্রা দ্রুত শহরের বিনোদন-তীর্থ হয়ে উঠল কলেজ পড়ুয়া থেকে বেকার যুবক, নবদম্পতি থেকে প্রৌঢ় প্রজন্মের কাছে।

শুধু সিনেমা নয়- বিচিত্রার পর্দার মতোই মনের পর্দায় ভাসছে পরপর অনেকগুলো ছবি। রবিবারের সিনে-ক্লাব, শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে ভোম্বল সর্দার দেখতে গিয়ে টিকিটের কাড়াকাড়ি, ইউবিআই অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের দৌলতে প্রথম প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের ইউনিক গলায় শুধু গান শোনা, আনিকেতের আয়োজনে সুমন চাটুজ্যের একক গানের শো ঘিরে উন্মাদনা কিংবা রাতভোর সংগীতের জিশু পীযূষকান্তির মন্দ্রিত কণ্ঠে রবিঠাকুরের গান- এইসব বড়ো প্রিয় এবং বিচিত্র স্মৃতিগুলো বিচিত্রাতেই। মালদায় সস্ত্রীক শেষ সিনেমা দেখাও এই পর্দাতেই (এক যে আছে কন্যা)।

দেবাশিসদার গলায় বিপন্নতা স্পষ্ট। ব্যাখ্যাও। নিয়মিত ৩০ শতাংশ দর্শক পেলেও হলটা চালিয়ে নেওয়া যেত। ৫২ সপ্তাহের মধ্যে মাত্র ১২ সপ্তাহ ঠিকঠাক দর্শক পাচ্ছি। বাকি সময়ে? শূ্ন্যতা সেটা টের পাওয়া গেল ওর গলাতেও। হিসেবও পাওয়া গেল মোটামুটি একটা। টেনেটুনে হল চালাতে প্রতিমাসে গড় খরচা প্রায় ১.২৫ লক্ষ টাকা। আয়ের ভাঁড়াড়ে সেখানে মাসে জমা পড়ছে হাজার পঞ্চাশ।

বেতন বাড়ানোর দাবিতে বেশ কিছু দিন ধরে চলেছে বাম প্রভাবিত কর্মী সংগঠনের আন্দোলন। সঙ্গত অনেকটাই মানলেন মালিকগোষ্ঠী। কিন্তু জানিয়ে দিলেন দাবি মানার ক্ষেত্রে সমস্যা আর্থিক সঙ্গতি। পাশাপাশি অভিযোগ করলেন, আন্দোলনের জেরে হলমুখো হওয়া ছেড়েছেন অবশিষ্ট দর্শকদেরও অনেকেই। বইমেলায় এক আলোচনা সভায় জেলাশাসক শরদ দ্বিবেদী পরামর্শ দিয়েছিলেন, দর্শক টানতে আধুনিকীকরণ দরকার সিনেমা হলগুলির। দেবাশিস জোয়ারদারের বক্তব্য, যা পরিস্থিতি তাতে আধুনিকীকরণ দূরে থাক, স্ট্যাটাস ক্যুয়ো বজায় রাখাটাই একটা চ্যালেঞ্জ।

হিট ছবি এলে পরিবেশকরা আগেই ৭৫ শতাংশ টাকা বুঝে নেবেন। আর যে ছবি দাঁড়ায়নি তার ক্ষেত্রে টিকিট বিক্রির টাকা করতে হবে ফিফটি-ফিফটি। সব মিলিয়ে নাভিশ্বাস।

পরিস্থিতি গুরুতর মানলেন বিচিত্রা কর্মী সংগঠনের নেতা সিপিআই-এর জেলা সম্পাদক বাবলাদাও (তরুণ দাস)। সমস্যা তো আছেই। কিন্তু কর্মীদের আন্দোলনটাও পেটের দাবিতেই। ৩/৪ হাজার টাকায় সংসার চালানো অসম্ভব! রাজ্য সরকারের বিধি মেনেই ন্যূনতম মজুরি শুধু দাবি নয়, প্রাপ্য। ডেপুটি লেবার কমিশনারের মধ্যস্থতায় একাধিক বৈঠক হয়েছে। সমাধান সূত্র মেলেনি।

কর্মচারীদের কেউ কেউ বললেন, হল চালানো সত্যিই অসম্ভব হলে ঝাঁপ বন্ধের আগে প্রাপ্য বকেয়া মিটিয়ে দেওয়া হোক।

ধরে নেওয়া যাক, একটা বোঝাপড়া হয়েই গেল। তারপর? মন কি আদৌ মানতে চাইবে বিচিত্রার সেলুলয়েড থমকে গেল? নিরবিচ্ছিন্ন পাঁচ দশকের কলেজ-প্রেমের সাক্ষী বিচিত্রার পর্দা ফ্রিজ হয়ে গেলেও আমাদের অনেকের কয়েক ফোঁটা চোখের জল থেকে যাবে নির্বাক চলচ্চিত্রের মতোই। কিন্তু আজকের ডিজিটাল-প্রেম হয়তো অভ্যেসেই চোখ রাখবে ইউটিউবে। সময়ের প্রয়াণের সাক্ষী থাকবে বিচিত্রাও। (#BichitraCinemaHall)

আমাদের মালদা এখন টেলিগ্রামেও। জেলার প্রতিদিনের নিউজ পড়ুন আমাদের অফিসিয়াল চ্যানেলে। সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

ছবিঃ মিসবাহুল হক