দেবরাজ রায় চৌধুরী

Jul 9, 2019

এই শ্রাবণে আষাঢ়ে গল্প

এক

যে বছর দেশ স্বাধীন হল সে বছরই বিশম্ভরের সাথে বিয়ে হয়েছিল সৌদামিনীর৷ প্রথমে বিশম্ভরের খানিক আপত্তি ছিল, কিন্তু বাড়ির কর্তা সম্পর্কে বিশম্ভরের জ্যাঠা, স্বয়ং কথা দিয়েছেন তারপর কোনো ওজর আপত্তি টেকেনি৷কলকাতার চাকরি পাকা হওয়া ইস্তক বিশম্ভর বিয়ের ভাবনায় মশগুল৷তার স্বপ্নের সহধর্মিণী স্বাস্থ্যবতী, কিন্তু সৌদামিনী যে খুবই রোগা, বাড়ির বড়োরা একথা জ্যাঠামশাইের কানে তুলতে তিনি পাত্তাই দিলেন না৷ বললেন, বিয়ের আগে সব মেয়েই অমন রোগা থাকে পরে সব ঠিক হয়ে যাবে৷ তাছাড়া এমন লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে এ তল্লাটে আর একটাও নেই৷

তা অবশ্য ঠিক সৌদামিনীর গুণের অন্ত নেই রান্নাবান্না,হাতের কাজ সবেতেই সে পারদর্শী৷ গানের গলা মিষ্টি, রবি ঠাকুর, নজরুল সবার গানই তার গলায় চমৎকার খোলে৷ তাছাড়া সে মৃদুভাষিণী কিন্তু সুভাষিণী, সবার সঙ্গেই মানিয়ে চলতে জানে, বাড়ির বড়ো ছোটো সবাই তার স্বভাবে মুগ্ধ কিন্তু বিশম্ভরের যে মন ভরে না৷

সে সপ্তাহান্তে কলকাতা থেকে গ্রামের বাড়িতে ফেরে এই আশায় যে বউকে এইবার ভরাট লাগবে কিন্তু সৌদামিনীকে যেন আগের চেয়েও একটু রোগা মনে হয়৷ সৌদামিনী বাসরঘর থেকেই স্বামীর ইচ্ছার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল তাই মোটা হওয়ার চেষ্টায় সেও কোনো ত্রুটি রাখে না৷ দিনে প্রায় চারবার ভাত খায়, দুপুরে ভাত ঘুম দেয় এছাড়াও তার গ্রামের মহিলাদের বলে দেওয়া নানান টোটকাও প্রয়োগ করে কিন্তু না সৌদামিনীর হাড়ে মাংস লাগে না৷ বিশম্ভরের একেক সময় সব থেকেও জীবনটাকে কেমন বিষময় মনে হয়৷এরপর একদিন বিশম্ভরের এক লায়েক বন্ধু বিশম্ভরকে জানায় মদ্যপানে নাকি শরীরে মেদ জমে!

অনেক ভাবার পর সেই সপ্তাহে বিশম্ভর একখানা ব্র্যান্ডির বোতল লুকিয়ে বাড়ি নিয়ে গেল৷রাতে সবাই শুয়ে পড়লে অনেক ইতস্তত করে পুরোটা খুলে বলল, সৌদামিনী কিন্তু এক বাক্যে রাজি হয়ে গেল৷বিশম্ভর নিজে কোনোদিন ছুঁয়েও দেখেনি এসব ছাইপাঁশ সেদিনও খেলো না৷ কলকাতার বন্ধুর বলে দেওয়া মাপ মতো ঢেলে দিল সৌদামিনীকে, সে নাক টিপে কোনোরকমে গলাধঃকরণ করল সবটা তরল৷

এরপর প্রায় সত্তর বছর অতিক্রান্ত সৌদামিনীর বয়স নব্বই ছুঁয়েছে, এখনো দিব্যি সচল৷ বছর তিরিশ আগেই বিশম্ভর গত হয়েছেন, না সৌদামিনীর গায়ে মেদ ধরেনি তবে মনে মদ ধরেছিল৷ বর্তমানে তাঁর এক নাতি বিদেশ থেকে ঠাকুরমার জন্য নিয়ে আসে মহার্ঘ্য স্কচ, রোজ রাত্তিরে দু পাত্তর না খেলে ঘুমই আসবে না সৌদামিনীর৷

দুই

আক্ষরিক অর্থেই হেড আপিসের বড়োবাবু আর মানুষটিও বেজায় শান্ত, নিপাট ভালো মানুষ৷ তবে কোনো দাড়ি গোঁফের বালাই নেই, অবিনাশবাবুর মুখ একেবারে নিখুঁত কামানো৷ যে সময়ের কথা সে সময় মধ্যবিত্ত বাঙালি ছুটি ছাটাতে আত্মীয় কুটুমের বাড়ি নির্দ্বিধায় পরিবার সমেত দু-চারদিন কাটিয়ে আসত৷অবিনাশবাবুও স্ত্রী, পুত্র, কন্যা সমেত সেবার শীতের ছুটিতে গেলেন তাঁর শ্যালকের বাড়ি৷ কলকাতার ব্যস্ত ত্রস্ত জীবন থেকে দূরে মফস্‌সলে৷

ওখানে টাটকা শাকসবজি, মাছ, মুরগি তার সঙ্গে শ্যালকের স্ত্রীর হাতের স্বাদু রান্না, কটা দিন তোফা কাটল৷ যেদিন আসবেন সেদিন সকালে শ্যালকের সাথে তিনিও বাজারে গেলেন৷ শ্যালকের আপত্তি সত্ত্বেও নানারকম ভালো মন্দ বাজার করে ব্যাগ ভরতি করলেন৷ ফেরার পথে দেখলেন বিরাট মাঠে অনেক তুলো স্তৃপীকৃত৷ শহরের ধুনকররা বেশিরভাগই এখানেই নাকি তৈরি করে যাবতীয় লেপ, তোশক, বালিশ৷

দুপুরে খাওয়ার টেবিলে শ্যালকের স্ত্রী প্রশ্ন করলেন জামাইবাবু চিংড়ির মালাইকারীটা কেমন হয়েছে? অবিনাশবাবু চিন্তিত হয়ে বললেন ‘সে তো হয়েছে, কিন্তু এতো তুলো ধুনবে কে?’ বাড়িসুদ্ধ লোক ঘাবড়ে গেল, অবিনাশবাবু বুঝিয়ে দিলেন ওই যে দেখলাম মাঠে প্রচুর তুলো জড়ো করে রাখা... শ্যালক আশ্বস্ত করল, আরে ধুনকরও তো অনেক, আপনাকে ওসব ভাবতে হবে না, নিন চিংড়িটা খান রান্নাটা কিন্তু খাসা হয়েছে...৷ রাতে কলকাতা ফেরার ট্রেন ধরার আগে অবিনাশবাবু অন্তত পঞ্চাশবার সবাইকে জিজ্ঞেস করে গেলেন ‘এতো তুলো ধুনবে কে?’ শ্যালক তার উদ্বিগ্ন দিদিকে ভরসা দিল জামাইবাবু কলকাতা গিয়ে নানান কাজের চাপে সব ভুলে যাবে চিন্তা করিস না৷

পরদিন আপিসে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং দিল্লি থেকে খোদ বড়ো সাহেব উপস্থিত৷তিনি তখন কোম্পানির বাৎসরিক লাভক্ষতি নিয়ে গুরুগম্ভীর ভাষণ দিচ্ছিলেন৷ অবিনাশবাবু মাঝপথে তাঁকে থামিয়ে বলে উঠলেন ‘স্যার সবই তো বুঝলাম কিন্তু এতো তুলো ধুনবে কে?’ এরপর ব্যাপারটা গুরুতর আকার ধারণ করল৷অবিনাশবাবুকে আপিস থেকে ছুটি দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হল৷অনেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞের অনেক রকম প্রয়াস সব ব্যর্থ হল, এমনকি তাকে আবার শ্যালকের ওখানে সেই মাঠের ধারে নিয়ে গিয়ে দেখানো হল সব তুলো ধোনা হয়ে গেছে, কিচ্ছু আর পড়ে নেই৷ অবিনাশবাবু কোলকাতা ফিরে তার শ্যালকের নামে গালমন্দ করে বললেন ব্যাটা আমাকে গাধা ভেবেছে অন্য মাঠ ঘুরিয়ে বলে কিনা সব তুলো ধোনা হয়ে গেছে ইত্যাদি৷ অনেক ডাক্তার বদ্যি হাকিম দেখানো হল, কবিরাজি, ইউনানি কিছুই বাদ গেল না৷ কিন্তু অবিনাশবাবুর মাথা থেকে ‘এতো তুলো ধুনবে কে?’ বের হল না৷ তাঁর বাড়ির শান্তি রসাতলে গেল৷ স্ত্রীর চেহারা দুশ্চিন্তায় শুকিয়ে গেল৷ ছেলেমেয়ের পড়াশোনা লাটে উঠল কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না৷ দু-তিনটা সাধারণ কথা বলেই অবিনাশবাবু শঙ্কিত মুখে যাকে সামনে পান তাঁকে প্রশ্ন করেন ‘এতো তুলো ধুনবে কে?’

এই ঘটনার মাস ছয়েক পরে অবিনাশবাবু তখন ছুটি নিয়ে বাড়িতে, তার শ্যালকের ওখান থেকে শ্যালকের বন্ধু নিতাই অবিনাশবাবুকে দেখতে এল৷ অবিনাশবাবু যথারীতি তাঁকেও সেই প্রশ্ন করলেন- নিতাই ‘এতো তুলো ধুনবে কে? কিছু ভাবো’ নিতাই হঠাৎ কী মনে হল বলে দিল ‘ভাববার কিছু নেই জামাইবাবু, গত পরশু ওই মাঠে বিরাট আগুন, সব তুলো পুড়ে ছাই’৷ অবিনাশবাবু অনেকটা শ্বাস ছেড়ে বললেন- যাক বাঁচা গেল৷

এরপর তাঁর মুখে আর কোনদিন কোনো তুলোধোনার কথা শোনা যায়নি... সবাই ফিরে পেল সেই হেড আপিসের শান্ত নিপাট, ভালো মানুষ বড়োবাবুকে৷

ইলাসট্রেশন: মৃণাল শীল